ইমরান হোসেন
শরীয়াহ আইন, রাষ্ট্রীয় আইন দুটোই মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের উপর যথেষ্ট বিধান প্রণয়ন করেছে। দাম্পত্য জীবনের বিয়ে থেকে বিচ্ছেদ সবই এর আলোচ্য বিষয়। একইভাবে, বিবাহ বিচ্ছেদ পরবর্তী স্ত্রীর খোরপোষ ও বাদ যায়নি। ইংরেজীতে একে বলা হয় Post-divorce maintenance। একটি দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদের পর একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত স্বামী তার স্ত্রীকে যে খোরপোষ দিতে বাধ্য থাকে তাকে বলা হয় Post-divorce maintenance বা PDM। শরীয়াহ আইন এবং বাংলাদেশী আইন একই হলে ও ভারতীয় আইন এ ব্যাপারে একটু ভিন্ন। এই খোরপোষ শুধুমাত্র স্বামী তার স্ত্রীকে দেবে। কিন্তু আমেরিকার টেক্সাস অঙ্গরাজ্যসহ অনেকগুলো দেশে এই খোরপোষ স্বামী, স্ত্রী উভয়ই দিতে হয় প্রয়োজন অনুযায়ী। যেমন, বিচ্ছেদের পর স্বামী মামলা করে দিল তার বিচ্ছেদ পরবর্তী ভরণপোষণেরর জন্য। যদি সে আদালতে প্রমাণ করতে পারে যে,বর্তমানে তার কর্মসংস্থান নেই, তাদের বিয়ের বয়স কমপক্ষে ১০ বছর দীর্ঘায়িত হয়েছে, তবে কোর্ট স্ত্রীকে বিচ্ছেদ পরবর্তী ৩ বছর স্বামীকে ভরণপোষণ দেয়ার আদেশ দিবেন। এটাকে সেখানে বলা হয় Spousal Maintenance বলা হয়।
বাংলাদেশে PDM এর বিধান: সূরা বাক্বারার ২২৯,২৪১ নং আয়াতে এ ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে। ২৪১ নং আয়াতে “MATAA” শব্দটি নিয়ে সব বিতর্ক। ইসলামী আইনশাস্ত্রবিদরা বলেছেন,এর অর্থ ‘উপযুক্ত উপহার’। সুতরাং,স্ত্রী ভরণপোষণ পাবে শুধুমাত্র ইদ্দতের সময়।কিন্ত Hefzur Rahman Vs. Shamsun Nahar Begum মামলায় বাংলাদেশ হাইকোর্ট ভারতের Shah Banu vs. Mohammed Ahmed Khan মামলার অবজার্ভেশন অনুসরণ করেছেন। এই মামলায় ভারতের সুপ্রিমকোর্ট রায় দিয়েছেন,স্ত্রী যদি নিজের ভরণপোষণ চালাতে ব্যর্থ হয় তবে তার পূণরায় বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত পূর্ববর্তী স্বামী ভরণপোষণ দিতে বাধ্য থাকবে।
বাংলাদেশ হাইকোর্ট ও “Mataa” শব্দটিকে ব্যাখা করেছেন স্বামী কতৃক তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা,ভরণপোষণ ইত্যাদি এবং এটা স্ত্রী দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ না করা পর্যন্ত থাকবে। যদি ও আপিল বিভাগ পরে হাইকোর্টের রায় বাতিল করে শরীয়াহ বিধান প্রতিষ্ঠার পক্ষে মত দেন। যদিও PDM এর উপর বিশেষ কোন আইন নেই,তবুও দু-একটি বিধান উল্লেখ আছে। CrPC,1973 এর ১২৫ ধারায় এই ভরণপোষণেরর কথা বলা হয়েছে। সেখানে wife শব্দের অর্থ-একজন তালাকপ্রাপ্তা নারী যিনি বিচ্ছেদের পর দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করেন নি। সুতরাং, যতক্ষণ সে wife থাকবে ততক্ষণ তাকে ভরণপোষণ দিতে হবে। তবে রাজীব গান্ধী সরকার ১৯৮৬ সালে Shah Banu মামলার কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়ার জন্য Muslim Women (Protection of rights on Divorce) Act,1986 নামে একটি আইন পাশ করেন। এই আইনের ধারা ৩ অনুযায়ী,যদি কোন নারী ইদ্দতের পর নিজের ভরণপোষণ চালাতে না পারে তবে ম্যাজিস্ট্রেট তার যেসব আত্মীয় তার মৃত্যুর পর তার সম্পদের উত্তরাধিকারী হবে তাদের নির্দেশ দিতে পারবেন তার ভরণপোষণ দেয়ার জন্য। যদি এমন কেউ না থাকে তবে যারা ধনাঢ্য আত্মীয় তাদের নির্দেশ দেবেন,যদি এমন কেউ না থাকে তবে রাষ্ট্রীয় ওয়াকফ বোর্ডকে নির্দেশ দেবেন তার ভরণপোষণ দেয়ার জন্য।
যাহোক, বাংলাদেশের আইন হলো,স্ত্রী শুধুমাত্র তার ইদ্দতকালে ভরণপোষণ পাবেন, এর পরে নয়।
সুপারিশ: বাংলাদেশের নারীরা উন্নত রাষ্ট্রের অনুপাতে সুবিধাবঞ্চিত বিধায় তাদের বিচ্ছেদ পরবর্তী
ভরণপোষণ আইনে কিছু পরিবর্তন আনা দরকার।যেমন-
১) হাইকোর্ট এবং আপিল বিভাগের রায়ের একটি সমন্বিত সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে।
২) এ বিষয়ে একটি স্পেশাল আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে।
৩) টেক্সাসের মত বিচ্ছেদ পরবর্তী ৩ বছর অথবা মুসলিম আইনের Past Maintenance এর মত ৬ বছর সময় নির্ধারণ করা যেতে পারে ভরণপোষণের জন্য।
অতএব,বাংলাদেশের নারী সমাজকে আরো একধাপ এগিয়ে নিতে,বিবাহ পরবর্তী সময়ের নিরাপত্তা বিধানে ইদ্দত পরবর্তী ভরণপোষণের উপর সরকারকে একটি যৌক্তিক অবস্থান নিতে হবে। অন্যথায়,মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় পিছিয়ে থাকব আমরা।
আইন শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
Discussion about this post