বর্তমানে আমেরিকা-ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের প্রায় সব দেশেই ইংরেজি নববর্ষের আয়োজন খুবই জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপন করা হয়। ৩১ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক ইভ পার্টি বা থার্টি ফার্স্ট নাইট এখন সারা বিশ্বে পরিচিত। নতুন বছরে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ সম্ভাষণ এখন আন্তর্জাতিক সম্ভাষণে পরিণত বলা যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নববর্ষ পালনের রীতিনীতি কিন্তু এক নয়। কিছু কিছু মিল থাকলেও নববর্ষের অনুষ্ঠানের সঙ্গে যোগ হয় দেশীয় ঐতিহ্য। প্রত্যেক জাতিরই তাদের নিজস্ব রীতিনীতি, ধর্ম, জীবনযাপনের নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে। নববর্ষ উদযাপনের পদ্ধতিতেও এর প্রভাব দেখা যায়। তবে নববর্ষের কিছু প্রথা আছে অবাক করা এবং মজার।
আমেরিকায় নববর্ষে স্বজনদের বাড়ি বেড়ানোর ধুম পড়ে। পরদিন আমেরিকানরা জাতীয় খেলা ফুটবল দেখে এবং বাদ্য সহকারে বের করে শোভাযাত্রা। ঘোড়ার গাড়ির পেছনে এগিয়ে চলা এ শোভাযাত্রার নাম ‘রোজেস প্যারেড’।
চীন দেশে পূর্ণিমার শুরুর দিন থেকে শুক্লপক্ষের ১৫ দিন উৎসব চলে নববর্ষ উপলক্ষে। পৃথিবীতে একমাত্র চীনারাই নববর্ষ পালন করে প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী। নববর্ষের প্রথম দিনে তারা স্বর্গ ও পৃথিবীর দেবতাকে তুষ্ট করে নানা উপাসনা-উপাচারে, দ্বিতীয় দিন পূর্ব পুরুষের মঙ্গল কামনা করা হয়। ‘ওয়েইলু’ নামক বিশেষ ভোজনের আয়োজন করা হয় এদিন। পক্ষকালব্যাপী আলাদা আলাদা অনুষ্ঠানের মধ্যে সপ্তম দিনটি পালিত হয় ‘শস্য দিবস’ নামে। ’হাফত-সিন’ নামের বিশেষ খাবার এদিনের সর্বজনীন খাবার, যা সাত রকমের উপকরণে তৈরি করা হয়।
ফ্রান্সে বছরের শেষ দিনে ঘরে সব থাকা মদ শেষ করতেই হবে।নতুন বছরে ঘরে পুরানো মদ পরে থাকা অশুভ। সৌভাগ্য ঘরে আসবে না। তবে ঘরে থাকা মদ ফেলে দিলে চলবেনা। খেয়েই শেষ করতে হবে। তাই যদি আপনি ফ্রান্সের নববর্ষের সময় সেখানে থাকেন, আপনার মনে হবে ফরাসিরা যেন সবাই মাতাল, আর সেটা যেন খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।
প্যারাগুয়েতে বছরের শেষ পাঁচ দিন ঘরে কোন আগুন জ্বালানো হয় না। এমনকি কোন রান্নাও করা হয় না। ওই পাঁচ দিনকে তারা পালন করে “ ঠাণ্ডা খাবার খাওয়ার দিন” হিসেবে। ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টার পর নতুন বছরের ঘণ্টা বাজলে চুলায় আগুন ধরা হয়। পরিবারের সবাই একসাথে মজাদার খাবার খেতে খেতে নতুন বছরে পা রাখে।
পোল্যান্ডের তরুণীরা নববর্ষ উদযাপনের সময় খরগোশের মত কাপড় পরে এবং তারপর একত্রিত হয়ে খরগোশের মত লাফিয়ে লাফিয়ে শাকসবজি যোগার করে কুটুর কুটুর করে যত প্রকার আর যত পরিমান পারা যায় তত শাকসবজি খাবে। কারণ তারা মনে করে যে, শাক-সব্জি খেয়ে নতুন বছর শুরু হলে নতুন বছরের সব কাজ সুন্দর, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে।
পুরোনো বছরের শেষদিনে হাঙ্গেরীয়রা পাখি জাতের কোনো প্রাণী খাবে না। কারণ তারা মনে করে যদি মুরগি, হাঁস বা কবুতর খায়, তাহলে নতুন বছরের সব সৌভাগ্য উড়ে যাবে। নববর্ষে আত্মীয়স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবদের তারাও উপহার দিয়ে থাকে, তবে এ উপহারে যদি চিমনি পরিস্কার করা শ্রমিকের ছবি ছাপানো থাকে, তবে উপহারটি তাদের কাছে অধিক বেশি পছন্দের হয়। কারণ এর মানে হচ্ছে পুরোনো বছরের সব দুঃখ, দূর্দশা দূর হয়ে যাবে।
বুলগেরিয়ায় নতুন বছরে হাঁচি দেয়াকে শুভ লক্ষ্মণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বর্ষবরণের দিন বাড়িতে আসা কোন অতিথি যদি হাঁচি দেয় তাহলে বাড়ির কর্তা তাকে নিজের খামারে নিয়ে যান। এরপর হাঁচি দেয়া অতিথির প্রথম নজর খামারের যে পশুটির উপর পড়বে, সেই পশুটিকে গৃহকর্তা ওই ব্যাক্তিটিকে উপহার দেন। ভাগ্যে থাকলে অনেক অতিথি ঘোড়াও উপহার হিসেবে পেয়ে থাকেন। বুলগেরিয়ানদের ধারনা, অতিথি হাঁচি দিলে তা পুরো পরিবারের জন্য সুখ ও সমৃদ্ধি বয়ে নিয়ে আসে।
ভিয়েতনামে নববর্ষকে সংক্ষেপে ‘টেট’ শব্দে অভিহিত করা হয়। ভিয়েতনামীদের বিশ্বাস, ঈশ্বর ঘরে ঘরে বাস করেন। নববর্ষে বেড়াতে যান স্বর্গে। সেখানে বসে মর্ত্যরে লোক কি করছে, তা খতিয়ে দেখেন। বলা হয়, কার্প মাছের পিঠে চড়ে ঈশ্বর ভ্রমণেও বের হন। এ বিশ্বাসে অনেকে নদী বা পুকুরে কার্প মাছ ছাড়েন। তাছাড়া ভিয়েতনামের উত্তরে কিছু সংখ্যালঘু জাতি আছে যারা বছরের শেষ দিনে যে জলাধার থেকে প্রতিদিন পানি সংগ্রহ করে, সেই জলাধারে দল বেঁধে গিয়ে মোমবাতি জ্বেলে মাটিতে মাথা ছুঁয়ে প্রণাম করে সেখান থেকে এক কলসি পানি নিয়ে আসে।এরপর ওই পানি দিয়ে বছরের প্রথম দিন রান্না করে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার পর নিজেরা খায়।তবে বছরের প্রথম দিনের রান্নায় সূপ জাতীয় খাবার খেলে নাকি মাঠের ফসল বন্যায় ভেসে যাবে।
স্কটল্যান্ডে নববর্ষ উৎসব পরিচিত ‘হগমানে’ নামে। বছরের শুভাগমন স্মরণে কোনো কোনো গ্রামে মানুষ রাস্তায় ঢেলে দেয় ব্যারেল ব্যারেল টার। এদিন ‘ফাস্ট ফুটিং’ নামে উপহারসামগ্রী দেওয়ার একটি প্রথা চালু রয়েছে সেখানে।
বর্তমানকালে মিসরে নববর্ষে চাঁদ দেখে নববর্ষ ঘোষণা করেন দেশের ধর্মনেতা বা প্রধান মুফতি। বিশেষ ধরনের খাবারসহ ভোজ উৎসব এবং নতুন কাপড় পরার নিয়ম সেখানে। তারপর ঈদের মতো পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময়।
আফ্রিকার মাদাগাস্কারায় নতুন বছর শুরুর সাতদিন আগে থেকে মাংস খাওয়া বন্ধ।বছরের প্রথম দিন বাড়িতে মুরগির মাংস রান্না হবে। প্রথমে তা খেতে দেয়া হবে বাবা মাকে।
থাইল্যান্ডে একজন আরেকজনের গায়ে পানি ছিটিয়ে নববর্ষকে স্বাগত জানায়।এছাড়া থাইল্যান্ডে নববর্ষ উদ্যাপিত হয় ১৩-১৫ এপ্রিল (গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী), থাইরা বিশ্বাস করে, এই আচার পালনে পরবর্তী বছরে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হবে, যার ফলে ভালো ফসল ফলবে।
ইরানে প্রাচীনকাল থেকেই নববর্ষে নওরোজ উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এদিন কৃষকরা ক্ষেতে বপন করে বিভিন্ন শস্যের বীজ, ঘরদোর সাজায়, নতুন পোশাক পরে।
আর্জেন্টিনায় নববর্ষের আগের দিন রাতে পরিবারের সব সদস্য একত্রে খাবার টেবিলে বসে আহার করে। তার পর বড়রা নাচের অনুষ্ঠানে চলে যায়। ভোর পর্যন্ত চলে এ নাচের অনুষ্ঠান। নববর্ষের প্রথম দিন নদী বা পুকুরে সাঁতার কেটে তারা নববর্ষ উদযাপন করে।
কোরিয়ায় নববর্ষ শুরুর সময় কেউ ঘুমায় না। এ সময় ঘুমালে নাকি চোখের ভ্রূ সাদা হয়ে যায়! রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে টিভিতে ৩৩ বার ঘণ্টা বাজানো হয়। কোরিয়ার ৩৩ বীরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এটি করা হয়। কোরিয়ায় প্রায় সবাই সূর্যোদয় দেখে। সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ার সময় একজন আরেকজনকে শুভেচ্ছা জানায়।
মেক্সিকোতেও ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ১২ বার ঘণ্টা বাজানো হয়। এ সময় প্রতি ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে একটি করে আঙ্গুর খাওয়া হয়। তারা বিশ্বাস করে, এ সময় যা কামনা করা হয়, তাই পূরণ হয়।
জাপানে নববর্ষ উদযাপন করা হয় ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুসারে। শুভদিন হিসেবে অন্তত সূর্যাস্ত পর্যন্ত নববর্ষে হাস্যমুখর থাকে জাপানিরা। লোকাচার অনুযায়ী মন্দভাগ্য এড়াতে অনেকে বাড়ির সামনে টানিয়ে রাখে বিশেষভাবে তৈরি রশি। নতুন পোশাক, উত্তম আহার এবং বেড়ানো তাদের উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ। এছাড়াও নববর্ষ উদযাপন করতে জাপানিদের তোশিকোসোবা নুডলস খেতেই হবে।
ব্রাজিলের রিওডি জেনিরো সমুদ্র সৈকতে নববর্ষের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠানটি হয়। এর অন্যতম আকর্ষণ চোখ ধাঁধানো আতশবাজির প্রদর্শনী। এ দিন অনেক লোকই সাদা পোশাক পরিধান করে। সমুদ্রে সাতটি ডুব দিলে এবং সাতটি ফুল ছুঁড়ে দিয়ে তারা মনে করে বছরটি খুব ভালো কাটবে। এ উৎসবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় দুই মিলিয়ন পর্যটক যোগ দেয়।
গ্রিসে বাচ্চারা নববর্ষের রাতে আগুন জ্বালিয়ে আগুনের কুণ্ডের কাছে তাদের জুতা জোড়া ফেলে আসে। তাদের বিশ্বাস, মহানুভব দেবতা বাসিল তাদের জুতাগুলো উপহারে পূর্ণ করে দেব খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০০ সালে প্রাচীন গ্রিসে নববর্ষ উদ্যাপন করা হতো একটি নবজাতক শিশুকে দিয়ে।
স্পেনে রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ১২টা আঙ্গুর খেয়ে নববর্ষের প্রথম ক্ষণটি উদযাপন করা হয়।
সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ায় সেন্ট সিলভেস্টারের পোশাকে সজ্জিত হয়ে নববর্ষকে স্বাগত জানায়
আমেরিকান ও জার্মানরা নববর্ষ উপলক্ষে শিশু শোভাযাত্রার আয়োজন করে। এর প্রচলন হয়েছিল চৌদ্দ শতকে।
জার্মানিতে নববর্ষের প্রথা হলো, গলিত পারদ ঠান্ডা পানিতে ফেলে তা যে আকারের হবে, সেটা দেখে অন্যের ভাগ্য বলার চেষ্টা করা।
বিশ্বের সকল দেশে গ্রেগরিয়ান নববর্ষ উদযাপিত হলেও সকল দেশে এটি প্রধান নববর্ষ উৎসব নয়। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সমূহে আরবি নববর্ষকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষকে উৎসবের সাথে পালন কর হয় আবার চীনে চীনা পঞ্জিকা অনুসারে নববর্ষ পালন করা হয়। এছাড়াও বিশ্বের অনেক উপজাতিরা তাদের নিজস্ব দিবসে নববর্ষ উৎযাপন করে। তবে এটা বলা যায় কিছু দেশে আলাদা নববর্ষের দিন থাকলেও সাধারণভাবে এখন বর্তমান বিশ্বের সকল দেশের নববর্ষের দিন ০১ জানুয়ারি।
Discussion about this post