বিডিলনিউজঃ আগামীকাল বুধবার চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই বহুল আলোচিত বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। তাকে কুপিয়ে হত্যা করার সময় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ফুটেজ ও সাক্ষীদের সাক্ষ্যে আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় আদালতে। এর ভিত্তিতে গত ৪ ডিসেম্বর মামলায় যুক্তিতর্ক শেষে রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রার্থনা করেন। একই দিনে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের বিচারক এবিএম নিজামুল হক আগামীকাল বুধবার মামলার রায়ের জন্য দিন ধার্য করেন। তবে, আসামিদের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীরা আদালতে যুক্তিতর্ক শেষে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে রাষ্ট্রপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে মর্মে তাদের বেকসুর খালাস দাবি করেন।
রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী বিশেষ পিপি এস এম রফিকুল ইসলাম প্রতিবেদককে বলেন, বিজয়ের গৌরবময় এ মাসেই গত বছর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ ক্যাডারদের পৈশাচিক কর্মকাণ্ড গণমাধ্যমের বদৌলতে সারা দেশের মানুষ তথা বিশ্ববাসী দেখেছে। বিনা কারণে নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যার এ দৃশ্য আমাদের বর্বর যুগের কথা মনে করিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে শিক্ষালাভ করে একজন ছাত্র জাতির প্রতি, সমাজের মানুষের প্রতি নিজেদের দায়বদ্ধতা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে। কিন্তু, এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের যে দৃশ্য সেদিন বিশ্ববাসী দেখেছে তা কেউ হয়তো কোনদিন ভুলতে পারবে না। আজকের এ সভ্য সমাজের সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত সন্তানদের কাছ থেকে এ ধরনের বর্বরতা আশা করা যায় না। আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করে জাতির পক্ষে এ দায় শোধ করতে হবে। নইলে আমরা নিজেদের বিবেকের কাছে, এ জাতির কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবো।
তিনি বলেন, ঘটনার সময় বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় ধারণকৃত ভিজুয়্যাল ও প্রিন্ট মিডিয়ার সচিত্র প্রতিবেদন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেছেন। এ ছাড়া এ সংক্রান্ত মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা চার আসামি রফিকুল ইসলাম শাকিল, এমদাদুল হক এমদাদ, রাশেদুজ্জামান শাওন ও মাহফুজুর রহমান নাহিদ ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারা মতে স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকার করেছেন ও পলাতক অন্যান্য আসামিদের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে জবানবন্দি দিয়েছেন।
এ মামলার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সাক্ষী রিকশাচালক রিপন সরকার তার সাক্ষে বলেছেন, বিশ্বজিৎকে কোপানোর পর দৌড়াতে গিয়ে রাস্তায় পড়ে যান তিনি। কেউ তাকে ধরতে যায়নি। তিনিই তার রিকশায় করে বিশ্বজিতকে মিডফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানেই মারা যান বিশ্বজিৎ। রিপন তার সাক্ষে হাসপাতালে কর্তব্যরত ডাক্তারদের অবহেলার বিষয়টিও উল্লেখ করেন।
তিনি আরও বলেন, মামলার বিচার চলাকালে গত ১ অক্টোবর এ মামলার অভিযোগপত্র দাখিলকারী তদন্ত কর্মকর্তা ট্রাইবুনালে সাক্ষ্য দেন। ওইদিন এ সংক্রান্ত সাক্ষ্য দিতে এসে বেসরকারি টেলিভিশনের সংগৃহীত ফুটেজ ও বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ার সচিত্র প্রতিবেদন দাখিল করেন। এ ছাড়া ভিজুয়্যাল সিডি ল্যাপটপ কম্পিউটারের মাধ্যমে প্রকাশ্য আদালতে তিনি তা প্রদর্শন করেন।
এদিন সাক্ষীর সাক্ষ্যে তদন্ত কর্মকর্তা ট্রাইব্যুনালে তার দেওয়া জবানবন্দিতে ধারাবাহিকভাবে জানান, ঘটনার দিন গত বছরের ৯ ডিসেম্বর এটিএন বাংলা চ্যানেলের সন্ধ্যা ৭টার সংবাদ থেকে ধারণকৃত ফুটেজের ধারাবাহিক ভাষ্য নিম্নরূপ:
সাদা ক্যাপ মুখে রুমাল বাঁধা হাতে রক্তমাখা ছুরি নিয়ে উপর হতে নীচে নামতে দেখা যাচ্ছে আসামি রাজন তালুকদারকে। লাল গেঞ্জি পরিহিত কাইয়ুম ওরফে টিপুকে অস্পষ্টভাবে ঘটনাস্থলে দেখা যাচ্ছে। হাফ সোয়েটার লাল শার্ট পরিহিত খন্দকার ইউনুস ইনটেনসিভ ডেন্টাল কেয়ারের ভিতর থেকে ইট মারতে মারতে নিয়ে আসতে দেখা যায়। ভিকটিম বিশ্বজিতের শরীরে আঘাতের ফলে রক্ত বারান্দায় পড়েছে তার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।
আসামি নাহিদ সাদা ফুল হাতা শার্ট, নীল রং এর সোয়েটার পরা অবস্থায় বাম হাতে ভিকটিমকে ধরে ডান হাতে মারতে দেখা যায়। আসামি আবদুল আজিজ সাদা শার্ট, জিন্সের প্যান্ট পরিহিত সাদা চাদর গায়ে বাম হাতে বিশ্বজিৎকে ধরে ডান হাতে মারতে দেখা যায়। আসামি রাশেদুজ্জামান শাওন ফুল হাতা সাদা হালকা মেরুন কালারের ষ্ট্রাইপ গেঞ্জি পরা অবস্থায় ডান হাতে থাকা রড দিয়ে পেটাতে দেখা যাচ্ছে।
আসামি ইমদাদ সাদা ষ্ট্রাইপ ফুলহাতা গেঞ্জি জিন্সের প্যান্ট পরা অবস্থায় দুই হাতে রড দিয়ে বিশ্বজিতের মাথা লক্ষ্য করে মারতে দেখা যায়। আসামি রফিকুল ইসলাম কালো ফুলহাতা গেঞ্জি ও জিন্সের প্যান্ট পড়া অবস্থায় দুই হাতে রড দিয়ে ভিকটিমকে পেটাতে দেখা যায়।
একুশে টেলিভিশন চ্যানেলে ঘটনার সময় সকাল ৯টায় ধারণকৃত দৃশ্যের ধারা ভাষ্য: আসামি নাহিদ, এমদাদ, কিবরিয়াকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা ছাত্রলীগের মিছিলের সামনের দিকে দেখা যাচ্ছে। রফিকুল ইসলাম শাকিল ইনটেনসিভ কেয়ারে প্রবেশের দরজায় বিশ্বজিৎকে ডান হাতে থাকা চাপাতি দিয়ে কোপাতে দেখা যায়। কিবরিয়াকে পাশে দাঁড়ানো দেখা যাচ্ছে।
চ্যানেল ৭১ টেলিভিশনে ধারণকৃত দৃশ্য ও ধারাভাষ্য: আসামি তমালকে ঘিয়া রংয়ের সাফারি পরা অবস্থায় হাতে কাঠের রোল দিয়ে বিশ্বজিতের মাথায় আঘাত করতে দেখা যায়। ওবায়দুল কাদের তাহসিন লাল শার্ট ও চশমা পরা অবস্থায় বিশ্বজিৎকে ভিতর থেকে টেনে এনে শাকিলকে কোপাতে সহায়তা করে।
আলাউদ্দিন সাদা সোয়েটার যাতে ভিকটিমের শরীরের রক্ত লাগা অবস্থায় বিশ্বজিতের পকেট হাতাইতে দেখা যায়। শাকিলকে ভিকটিমের রক্ত তার গায়ে লাগা অবস্থায় বের হয়ে আসতে দেখা যায়। আল আমিন টিয়া রংয়ের ফুলহাতা গলাবদ্ধ গেঞ্জি পরা অবস্থায় ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
বাংলাভিশন চ্যানেলে ধারণকৃত ফুটেজে আসামি লিমনকে খয়েরী জ্যাকেট পরা অবস্থায় ঘটনাস্থলে দেখা যায়। সাইফুলের আংশিক ছবি দেখা যায়। যার মুখ দেখা যায়।
প্রসঙ্গত, এ মামলার অভিযোগপত্র দাখিলের পর মামলাটি বিচারের জন্য বদলী মূলে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। গত ২৬ মে সংশ্লিষ্ট বিচারক মো. জহুরুল হক আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আমলে গ্রহণ করেন। একই বিচারক গত ২ জুন অভিযোগপত্রভুক্ত সকল আসামির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারায় সংঘবদ্ধভাবে হত্যার অভিযোগ গঠন করেন।
গত ১৮ জন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন অধিবেশনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর সরকারের গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে মামলাটির বিচার নিষ্পত্তির জন্য গত ২৭ জুন ৪ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। গত ১৪ জুলাই সাক্ষিদের সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা শুরু হয়ে গত ২৪ অক্টোবর শেষ হয়। অভিযোগপত্রভুক্ত ৬০ জন সাক্ষির মধ্যে ৩২ জনকে আদালতে উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
এরপর গত ১৭ নভেম্বর আসামিদের পরীক্ষা করা হয়। ১৯ নভেম্বর আসামিদের পক্ষে সাফাই সাক্ষি গ্রহণ করা হয়। ২৭ নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে টানা ছয় (৬) কার্যদিবস যুক্তিতর্ক শুনানির পর ৪ ডিসেম্বর শেষ হয়। ঘটনার প্রায় ২ মাস ২৪ দিন পর তদন্ত শেষে এ বছরের ৫ মার্চ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা (দক্ষিণ) পুলিশের পরিদর্শক তাজুল ইসলাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের ২১ নেতা-কর্মীকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
এদের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন মাত্র ৮ জন। এরা হলেন: রফিকুল ইসলাম শাকিল, মাহফুজুর রহমান নাহিদ, এমদাদুল হক এমদাদ, জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন, এ এইচ এম কিবরিয়া, সাইফুল ইসলাম, কাইয়ুম মিঞা এবং গোলাম মোস্তফা। পলাতক রয়েছেন ১৩ জন। এদের গ্রেপ্তারে প্রশাসনের কোনও উদ্যোগ নেই।
পলাতকরা হলেন: রাজন তালুকদার, খন্দকার মো. ইউনুস আলী, তারিক বিন জোহর তমাল, আজিজুর রহমান আজিজ, মীর মো. নূরে আলম লিমন, ওবায়দুর কাদের তাহসিন, আলাউদ্দিন, রফিকুল ইসলাম, ইমরান হোসেন ইমরান, আল-আমিন শেখ, কামরুল হাসান, মনিরুল হক পাভেল ও মোশারফ হোসেন।
পলাতকদের কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছেনা- এ প্রসঙ্গে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, “আমরা বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার আসামিদের ধরতে তত্পর রয়েছি। পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা আছে। ওই পরোয়ানা প্রত্যেক আসামির সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠানো হয়েছে। আমরা নিয়মিত সেখানে খোঁজ নিয়ে থাকি। আসামিদের গ্রেপ্তারে জোর চেষ্টা চলছে।”
উল্লেখ্য, গত বছরের ৯ ডিসেম্বর বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ক্যাডারদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন নিরীহ দর্জি বিশ্বজিৎ দাস। ওইদিন রাত সোয়া ৮টার দিকে অজ্ঞাতনামা ২৫ জন আসামির বিরুদ্ধে সূত্রাপুর থানায় মামলা করে পুলিশ।
Discussion about this post