ফেনী প্রতিনিধি: ফেনীতে পুলিশের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের পাইকারি স্বর্ণ ব্যবসায়ীর করা ডাকাতি মামলায় ডিবির ওসি সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়াসহ অন্য পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তার রিমান্ড চলছে। রিমান্ডের প্রথম দিন বৃহস্পতিবার তাদের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। বুধবার রাত থেকেই তাদেরকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তথ্য জানাননি। তারা বলছেন ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা আগেই পাওয়া গেছে। বর্তমানে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হলে এ নিয়ে বিস্তারিত জানানো হবে। আর প্রয়োজন হলে আসামীদের আবারো রিমান্ডে নেওয়া হবে। এর আগে বুধবার গ্রেপ্তারকৃত ডিবি ওসি সাইফুল ইসলামকে চার দিন ও এসআই মোতাহের হোসেন, এসআই মিজানুর রহমান, এসআই নুরুল হক এবং এএসআই অভিজিৎ রায় ও এএসআই মাসুদ রানাকে তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করে ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল্লাহ খান এ আদেশ দেন। পরে বুধবার বিকালে তাদের রিমান্ডে নেওয়ার জন্য কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আদালত থেকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।
এদিকে বর্তমানে ওই ব্যবসায়ী চট্টগ্রামে নিজের বাসায় অবস্থান করেছেন। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকলেও কোনো শঙ্কার মধ্যে নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি। তার দাবি ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ২০টি সোনার বার লুট করেছেন ফেনী গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ৬ কর্মকর্তা। ব্যবসায়ীর আরো দাবি প্রাণভিক্ষা চাইলে তার কাছে এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে অভিযুক্ত পুলিশেরা। আর ওই সময় স্বর্ণ ব্যবসায়ী বৈধ কাগজপত্র দেখালে পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, তোর কাছে যতই বৈধ কাগজপত্র থাকুক না কেন, তোকে ক্রসফায়ারে দেব। ব্যবসায়ী জানান, ছিনতাই হওয়া ২০টি স্বর্ণের বারের মোট ওজন দুই কেজি ৩৩০ গ্রাম। যার বাজারমূল্য প্রায় এক কোটি ২৭ লাখ ৮৪ হাজার ৬৩৬ টাকা।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার হাজারী লেনের ইকুইটি কোহিনূর মার্কেটের দ্বিতীয়তলায় ‘আলো জুয়েলার্স’র স্বত্বাধিকারী তিনি। তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের চকরিয়া উপজেলায়। ওই ব্যবসায়ী এজাহারে বলেন, গত রবিবার বিকাল পৌনে ৪টার দিকে একটি প্রাইভেটকারে করে চট্টগ্রাম থেকে ২০ পিস স্বর্ণের বার নিয়ে উন্নতমানের অলঙ্কার তৈরির জন্য ঢাকার তাঁতীবাজারের উদ্দেশে রওনা হন। পথিমধ্যে বিকাল সোয়া ৫টার দিকে ফেনী মডেল থানার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফতেহপুর রেলওয়ে ওভারব্রিজের সামনে পৌঁছলে ওয়্যারলেস ও পিস্তলসহ গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের জ্যাকেট পরিহিত চারজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি তার গাড়ি থামতে সিগন্যাল দেয়। এ সময় রাস্তার পাশে আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্য দাঁড়ানো ছিল। গাড়ি থামানোর পরপরই জ্যাকেট পরিহিত তিনজন তার গাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে। এ সময় তাদের একজন ওই ব্যবসায়ীর মাথায় পিস্তল ধরে ও অন্য আরেকজন গাড়িচালক শওকতকে বেধম মারধর শুরু করে। এজাহারে আরো বলা হয়, মারধরের একপর্যায়ে তারা নিজেদের ফেনী ডিবি পুলিশের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘তোদের কাছে অবৈধ মালামাল আছে, তাড়াতাড়ি বের কর।’ তখন অবৈধ মালামাল না থাকার বিষয়টি জানিয়ে আমার কাছে থাকা ২০ পিস বৈধ স্বর্ণের কথা জানাই। তখন তারা ‘ডিবির ওসি স্যার আসতেছে, উনি এলে বিস্তারিত আলাপ হবে’- এমন কথা বলে। এভাবে ২০ থেকে ৩০ মিনিট চলার পর সাদা রঙের একটি কারে করে সাদা পোশাকে একজন কর্মকর্তা আসতেই তারা জোর করে আমাকে ওই গাড়িতে উঠায়। এ ছাড়া যারা সিগন্যাল দিয়ে দাঁড় করিয়েছিল তারা ছিল নীল রঙের আইআরএক্স হায়েসে।
ব্যবসায়ী বলেন, গাড়িতে ওঠানোর পর ঊর্ধ্বতন ওই কর্মকর্তা স্বর্ণের বারগুলো দেখতে চাইলে তাকে দেখানোমাত্র তিনি কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে বলেন, ‘তোর কাছে যতই বৈধ কাগজপত্র থাকুক না কেন এ মুহূর্তে তোকে ক্রসফায়ারে দেব অথবা ৫০০ থেকে ৭০০ পিস ইয়াবা দিয়ে চালান দেব।’ তখন আমি ভয় পেয়ে তাদের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলে তারা বলে, ‘স্বর্ণের বারগুলো তো পাবিই না, তোর এই গাড়ি, ড্রাইভার ও তোর নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য এক কোটি টাকা দিতে হবে। শুধু তাই নয়, ঘটনাস্থল থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে ফ্লাইওভারের নিচে রেলগেট সংলগ্ন নির্জন এলাকায় নিয়ে প্রায় ৩ ঘণ্টা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে তারা। তাদের নির্যাতনে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে একপর্যায়ে তারা আমাকে দিয়ে এটা বলতে বাধ্য করে যে, ‘আমার কাছে তারা ১২ পিস স্বর্ণের বার পেয়েছে যার বৈধ কাগজ দেখালে তারা আমাকে ছেড়ে দেয়।’ একই সঙ্গে আমার দেওয়া বক্তব্য জোর করে ভিডিও ধারণ করে এবং ঘটনাটি কারও কাছে প্রকাশ করলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এরপর তাকে ওই কর্মকর্তার গাড়িতেই চোখ বেঁধে অজানা গন্তব্যে রওনা হয়ে বেশ কিছুদূর গিয়ে গাড়িটি এক জায়গায় থামায়। ব্যবসায়ী গোপাল কান্তি দাস বলেন, গাড়িটি থামার পর তারা চোখ খুলে দিলে গাড়ি থেকে নেমে জায়গাটি বারৈয়ারহাট বলে দেখতে পাই। ওই সময় তারা আবারও আগের মতো জোর করে স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিও ধারণ করে। সবশেষে রাত প্রায় সোয়া ৮টার দিকে আমার গাড়িতে চালক শওকতকেসহ তুলে দিয়ে সোজা বাড়ি ফিরে যেতে বলে। ওই সময় তারা বলে, ‘এখানে যা হয়েছে সব ভুলে যাও’। এ ঘটনা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে মেরে ফেলার হুমকিও দেয় তারা। পরবর্তী সময়ে তিনি গাড়ি নিয়ে সোজা চট্টগ্রামে নিজ বাসায় ফিরে যান। রাতেই তিনি বাড়িতে ফিরে ঘটনাটি তার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও স্বর্ণ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে জানান। পরে সবার পরামর্শে মঙ্গলবার ফেনী মডেল থানায় হাজির হয়ে বিষয়টি থানার ওসিকে মৌখিকভাবে জানান। তখন ওসি বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এক পর্যায়ে ওইদিন দুপুর ১টা ২০ মিনিটে পুলিশ লাইনে কর্মরত ডিবির কর্মকর্তাদের জ্যাকেট পরিহিত অবস্থায় হাজির করলে ডিবির ওসি মো. সাইফুল ইসলাম, এসআই মোতাহের হোসেন, এসআই নুরুল হক ও এএসআই মাসুদ রানাকে শনাক্ত করতে সক্ষম হন তিনি। তাদের রবিবার ঘটনা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা স্বর্ণের বার ছিনিয়ে নেওয়ার কথা স্বীকার করে এবং বারগুলো ওসি ডিবির বাসায় রয়েছে বলে জানায়।
বৃহস্পতিবার ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিকদের জানান, রবিবারের ঘটনায় আমি অসুস্থ ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় আছি। বর্তমানে চট্টগ্রামে অবস্থান করছি। পুলিশ আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করছে। বর্তমানে আমি কোনো শঙ্কার মধ্যে নেই। তবে সেদিনের ঘটনায় আমি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। এজন্য আমি ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করছি।
Discussion about this post