গত বছর রাজধানীর একটি চেইন সুপারশপ থেকে কিছু প্রসাধনপণ্য কিনেছিলেন সরকারি চাকরিজীবী ফারুক আজম। একটি পণ্যের গায়ে লেখা সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের চেয়েও ৩৬ টাকা বেশি রাখা হয় ওই সুপারশপে। এর প্রতিবাদ করলে সুপারশপটির কর্মকর্তারা বলেন, কিছুই করার নেই।
ফারুক ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করেন ২০১৬ সালে। তদন্তের পর ওই সুপারশপকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়, তা থেকে আড়াই হাজার টাকা পান তিনি।
২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন করা হয়েছিল। ভোক্তা হিসেবে কারও কোনো অভিযোগ থাকলে এ আইনের বলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর নামে একটি সরকারি দপ্তরে গিয়ে অভিযোগ করা যায়। ওই দপ্তর অভিযোগ তদন্ত করে। প্রমাণিত হলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর মধ্যে আছে জরিমানা বা কারাদণ্ডের বিধান। এক বছর থেকে তিন বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডের শাস্তি রাখা আছে বিধানে। এর বিকল্প হিসেবে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যায়। দণ্ডিত ব্যক্তি আবার একই অপরাধ করলে সর্বোচ্চ পরিমাণের দ্বিগুণ দণ্ডের বিধান আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, জরিমানা হলে অভিযোগকারী ভোক্তাকে মোট জরিমানার ২৫ শতাংশ তাৎক্ষণিকভাবে দেওয়া হয়।
অভিযোগ ক্রমশ বাড়ছে
২০১০ সালের ৬ এপ্রিল থেকে বাস্তবায়ন শুরু হয় এ আইন। তবে এ রকম একটি আইন যে আছে, ভোক্তাদের বেশির ভাগেরই তা জানা নেই। এ কারণে প্রথম তিন বছরে (২০১০ থেকে ২০১৩) গড়ে এক শর মতো অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে ২০১৪ সালে ৫৩৭টি অভিযোগ জমা পড়ে। আর ২০১৬ সালে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬২২টিতে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম লস্কর বলেন, অনেকেই এ আইন সম্পর্কে জানেন না। তবে জানার হার বাড়ছে। নিয়মিত প্রচার চালানো হচ্ছে। গণশুনানি, সভা ও সেমিনার করা হচ্ছে। পোস্টার ও লিফলেট তৈরি করে বিতরণ করা হচ্ছে।
ভোক্তা অভিযোগ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাসুম আরেফিন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অধিদপ্তর সক্রিয় হয়েছে। এখন সারা বাংলাদেশ থেকেই ভোক্তারা অধিদপ্তরে অভিযোগ করছেন।
তবে অভিযোগের সংখ্যায় সন্তুষ্ট নয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণবিষয়ক সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। ক্যাবের সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ভোক্তা তো মোটামুটি আমরা সবাই। যাঁরাই ক্রয় করেন, তাঁরাই ভোক্তা। আমাদের দেশের যে পরিস্থিতি, সে অনুযায়ী বর্তমানের চেয়ে ১০ গুণ বেশি অভিযোগ আসা উচিত। কিন্তু ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর যে আছে, এটি খুব বেশি ভোক্তা জানেন বলে আমার মনে হয় না।’
অভিযোগ প্রমাণ করাই কঠিন
২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত অধিদপ্তরে ভোক্তাদের করা মোট লিখিত অভিযোগ পড়েছে ২ হাজার ৫৬৩টি। এর মধ্যে ২ হাজার ৪৫৮টি অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়েছে। আর তদন্তাধীন আছে ১০৫টি অভিযোগ। অর্থাৎ দায়ের করা মোট অভিযোগের প্রায় ৯৫ শতাংশই নিষ্পত্তি হয়েছে।
তবে এসব অভিযোগের মধ্যে মাত্র ৬৩৯টি ঘটনায় জরিমানা করা হয়েছে। অর্থাৎ, ২৫ শতাংশ অভিযোগ প্রমাণ করা গেছে।
জরিমানার অংশ হিসেবে ভোক্তারা মোট ১০ লাখ ৮ হাজার ৮০০ টাকা পেয়েছেন। আর জরিমানার বাকি অংশ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে।
অধিদপ্তরের ভোক্তা অভিযোগ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাসুম আরেফিন বলেন, অনেক ক্ষেত্রে আবেদন সঠিক নিয়মে বা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে করা হয়নি। আবার অনেক অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে লিখিত অভিযোগ দায়ের করতে হয়। অভিযোগকারীর কাছে অবশ্যই অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র বা সেবা নেওয়ার রসিদ থাকতে হয়। মোবাইল ফোনে এসএমএস করে, ফ্যাক্স বা ই-মেইলে অভিযোগ করা যায়। অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে থাকা অভিযোগ ফরম পূরণ করেও অভিযোগ করা যায়।
ভোক্তা অভিযোগ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাসুম আরেফিন বলেন, অভিযোগ করার সাত দিনের মধ্যে অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত পক্ষের কাছে অধিদপ্তর থেকে চিঠি দেওয়া হয়। এরপর দুই পক্ষের উপস্থিতিতে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা হয়। সাধারণত দুই সপ্তাহের মধ্যে অভিযোগের নিষ্পত্তি করা হয়। তবে কোনো পণ্যের রাসায়নিক পরীক্ষা করার প্রয়োজন হলে সময় বেশি লাগে।
নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দাম নেওয়া, ভেজাল পণ্য বিক্রি, মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাদের প্রতারণা, প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রি বা সরবরাহ না করা, ওজনে ও পরিমাপে কারচুপি, নকল বা মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি, কোনো দোকান বা প্রতিষ্ঠানে সেবার মূল্যের তালিকা না টাঙানো প্রভৃতি কারণে ভোক্তাদের অভিযোগ করার অধিকার আছে।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, বর্তমানে ৩৯টি জেলায় অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আছেন, ২৫টি জেলায় নেই। তবে কর্মকর্তার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, এ আইন সম্পর্কে তেমন প্রচার হয়নি। কিছু টিভি কমার্শিয়াল দেওয়া হলে মানুষের এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ত।
Discussion about this post