নিজস্ব প্রতিবেদক: করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণ ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনকে সহায়তা করতে আজ মঙ্গলবার থেকে সারাদেশে দায়িত্ব পালন করবে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী (সশস্ত্র বাহিনী)। একইসঙ্গে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে আগামী ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। এর আওতায় সরকারি-বেসকারি অফিস-আদালত বন্ধ থাকবে। তবে হাসপাতালসহ জরুরি সেবা সংস্থাগুলো এই ছুটির আওতায় পড়বে না।
ছুটির সময় গণপরিবহন সীমিত আকারে চলাচল করবে এবং ব্যাংকও সীমিত পরিসরে খোলা থাকবে। মানুষকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে এবং যারা অসুস্থ তারা যেন মসজিদে বা বাইরে না যান, সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে। করোনা চিকিৎসায় ৫০০ জন চিকিৎসকের তালিকা তৈরি করে প্রস্তুত করা হচ্ছে। সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সমাগম সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করাসহ ১০টি নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি গতকাল সোমবার সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে এ নির্দেশনা দেন।
গতকাল সোমবার বিকালে সচিবালয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউস দেশে নভেল করোনা ভাইরাস মহামারি ঠেকাতে সরকারের নানা কার্যক্রম তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতিতে সবাই সম্মিলিতভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলে সংকট মোকাবেলা করা যাবে।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউস বলেন, লকডাউন বলে কিছু নেই। দরকার সামাজিক দূরত্ব। সরকার সবসময় এটিকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করছে। নারায়ণগঞ্জে আক্রান্ত তিনজন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। আমাদের ডাক্তারদের ভালো করে তোলার সামর্থ্য আছে। আতঙ্কের কিছু নেই।
তৈরি পোশাক কারখানা খোলা থাকবে কিনা জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বলেন, আমাদের স্বাস্থ্য প্রফেশনালস যারা আছেন তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। গার্মেন্টসে যারা কাজ করেন তাদের সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এখানে একটা জিনিস আছে, কেউ যদি ইনফেক্টেড হয়, তাহলে সে আর অন্য ফ্যাক্টরিতে যাচ্ছে না। ধরেন পাঁচ-ছয়জন ইনফেক্টেড হয়ে যদি ছুটিতে যায় তাহলে ছড়ানোর আশঙ্কা বেশি। গার্মেন্ট মালিকরা স্যানিটাইজার, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন। গ্লাভস ও মাস্ক ব্যবহার করেই কর্মীরা কাজ করে যাচ্ছেন। মালিকরা সিদ্ধান্ত নেবেন তারা কী করবেন।
গার্মেন্টস বন্ধ করতে বাধ্যবাধকতা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে মুখ্য সচিব বলেন, গার্মেন্টস কর্মীদের আমরা পিপিই ও মাস্ক তৈরির কাজে ব্যবহার করছি। তারা আমাদের প্রচুর সহায়তা করছে। রবিবার চট্টগ্রাম থেকে ১০ হাজার মাস্ক নিয়েছি। আরও ৯০ হাজার পাচ্ছি। এভাবে বিভিন্ন এলাকা থেকে আমরা নিচ্ছি।
বৈশ্বিক মহামারিতে রূপ নেওয়া কোভিড-১৯ রোগে বাংলাদেশে ৩৩ জন আক্রান্ত হয়েছেন; মারা গেছেন তিনজন।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে সামাজিক দূরত্ব ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুবিধার্থে সশস্ত্র বাহিনী প্রশাসনকে সহায়তায় নিয়োজিত হবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সমন্বয়ে তারা জেলা ও বিভাগীয় করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থা, সন্দেহজনক ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা পর্যালোচনা করবে। সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ করে বিদেশফেরত ব্যক্তিদের কেউ নির্ধারিত কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক সময় পালনে ত্রুটি বা অবহেলা করছে কি না, তা পর্যালোচনা করবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা এজন্য স্থানীয় কমান্ডারের কাছে সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক অবস্থা পর্যালোচনার জন্য আইনুসারে অনুরোধ জানাবে বলেও জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব প্রধানমন্ত্রীর ১০টি নির্দেশনার কথা সাংবাদিকদের জানান। তিনি বলেন, আগামী ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি। এরপর ২৭ ও ২৮ মার্চ সরকারি সাপ্তাহিক ছুটি। ২৯ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত পরবর্তী পাঁচ দিন সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। এছাড়া ৩ ও ৪ এপ্রিলের সাপ্তাহিক ছুটি সাধারণ ছুটির সঙ্গে যোগ হবে। অর্থাৎ ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান ছুটির আওতায় থাকবে। তবে কাঁচাবাজার, খাবার, ওষুধের দোকান, হাসপাতালসহ জরুরি যেসব সেবা রয়েছে তার জন্য এসব প্রযোজ্য হবে না। জনসাধারণকে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া (খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ ক্রয় ও চিকিৎসা গ্রহণ ইত্যাদি) কোনোভাবেই ঘরের বাইরে না আসার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ইতিপূর্বে স্কুল ছুটি ঘোষণার পর দেখা গেছে, অনেকেই দেশের বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রে গেছেন। সাধারণ ছুটি মানে সরাসরি আইসোলেশন না হলেও নিজেকে পৃথক রেখে অন্যকে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা। এ সময়ে যদি কোনো অফিস-আদালতে প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করতে হয় তাহলে তাদের অনলাইনে সম্পাদন করতে হবে। সরকারি অফিস সময়ের মধ্যে যারা প্রয়োজন মনে করবে তারাই শুধু অফিস খোলা রাখবে।
গণপরিবহন চলাচল সীমিত থাকবে। জনসাধারণকে যথাসম্ভব গণপরিবহন পরিহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যারা জরুরি প্রয়োজনে গণপরিবহন ব্যবহার করবে তাদের অবশ্যই করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়া থেকে মুক্ত থাকতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেই গণপরিবহন ব্যবহার করতে হবে। গাড়িচালক ও সহকারীদের অবশ্যই গ্লাভস এবং মাস্ক পরাসহ পর্যাপ্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
জনগণের প্রয়োজন বিবেচনায় ছুটিকালীন বাংলাদেশ ব্যাংক সীমিত আকারে ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু রাখার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবে।
করোনা ভাইরাসের কারণে নিম্নের কোনো ব্যক্তি যদি স্বাভাবিক জীবনযাপনে অক্ষম হয় তাহলে সরকারের যে ঘরে ফেরার কর্মসূচি রয়েছে, সে কর্মসূচির মাধ্যমে তারা নিজ নিজ গ্রামে ফিরে গিয়ে আয় বৃদ্ধির সুযোগ পাবে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসকরা প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবেন।
ভাসানচরে এক লাখ লোকের আবাসন ও জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে সরকার। এ সময় যদি দরিদ্র কোনো ব্যক্তি ভাসানচরে যেতে চান তাহলে তারা যেতে পারবেন। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসকরা প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবেন।
করোনা ভাইরাসজনিত কার্যক্রম বাস্তবায়নের কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয়-অন্ন সংস্থানের অসুবিধা নিরসনের জন্য জেলা প্রশাসকদের খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে এ সহায়তা প্রদান করা হবে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য ৫০০ জন চিকিৎসকের তালিকা তৈরি ও তাদের প্রস্তুত রাখবে।
সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সমাগম সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিশেষ করে অসুস্থ, জ¦র-সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মসজিদে না যাওয়ার জন্য বারবার নিষেধ করা হয়েছে। তারপরও সম্প্রতি মিরপুরে একজন বৃদ্ধ অসুস্থ অবস্থায় মসজিদে যান। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ওই ব্যক্তি পরে মৃত্যুবরণ করেন। তাই ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতি অসুস্থ অবস্থায় মসজিদে নামাজ আদায় করতে না যাওয়ার অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।
এদিকে গতকাল সোমবার রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের বাংলাদেশে সংক্রমণ, বিস্তৃতির সম্ভাব্যতা ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বেসামরিক প্রশাসনের অনুরোধে বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলো এবং উপকূলীয় এলাকায় ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’-এর আওতায় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী নিয়োজিত থাকবে। মঙ্গলবার (২৪ মার্চ) থেকে বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে সামাজিক দূরত্ব ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুবিধার্থে সশস্ত্র বাহিনী তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের সমন্বয়ে সশস্ত্র বাহিনী করোনাভাইরাস সংক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা, সন্দেহজনক ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা পর্যালোচনা করবে। বিশেষ করে বিদেশ ফেরত ব্যক্তিদের কেউ নির্ধারিত কোয়ারেন্টিনের বাধ্যতামূলক সময় পালনে ত্রুটি ও অবহেলা করছে কিনা তা পর্যালোচনা করবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা স্থানীয় সেনা কমান্ডারের কাছে অবস্থা পর্যালোচনার জন্য আইন অনুসারে সশস্ত্র বাহিনীর নিকট অনুরোধ জানাবে।
নৌবাহিনী উপকূলীয় এলাকায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় কাজ করবে। বিমানবাহিনী হাসপাতালের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রী ও জরুরি পরিবহন কাজে নিয়োজিত থাকবে।
Discussion about this post