তুরিন আফরোজ
“আমার মাতৃভাষা তিব্বতের গুহাচারী, মনসার দর্পচূর্ণকারী
আরাকানের রাজসভার মণিময় অলঙ্কার, বরেন্দ্রভূমির
বাউলের উদাস আহ্বান, মাইকেল -রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ইসলাম
আমার মাতৃভাষা।আমার মাতৃভাষা বাংলা ভাষা।”
-মুনীর চৌধুরী
বাংলা আমার মায়ের ভাষা। বাংলা ভাষাতে আমি কথা বলি, গান গাই, হাসি, কাঁদি, মনের ভাব প্রকাশ করি। আমি যইে দেশে বাস করি তার নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং অনুচ্ছেদ ৭ অনুযায়ী সংবিধান হল প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। মহামান্য আদালত যদি প্রজাতন্ত্রের একটি বিভাগ হয়ে থাকে তবে আদালতের রায় কেন বাংলায় লেখা হবে না? মায়ের ভাষায় আদালতের রায় লিখতে অসুবিধাটা কোথায়?
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার সহ অজস্র শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ভাষা। পৃথিবীতে আর কোন জাতিকে তার মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকারের জন্য রক্ত দিতে হয়নি। অমর সাহিত্য বিশারদ মীর মশাররফ হোসেন লিখেছেন, “মাতৃভাষায় যাহার শ্রদ্ধা নাই সে মানুষ নহে”। তাহলে আদালত সহ প্রজাতন্ত্রের সর্বস্তরে আমরা বাংলা ভাষার প্রচলন কেন নিশ্চিত করতে পারছি না? আমরা কি তবে আমাদের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাহীন হয়ে অমানুষে পরিণত হয়ে উঠছি?
১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখে বাংলাদেশের স্থপতি সে দিনের তরুণ যুবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃপ্ত— কণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছিলেন, “বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক” (ভাষা সৈনিক জনাব গাজীউল হক)। ১৯৪৭ এর ৭ই সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি -সুদীর্ঘ ১৬৩৫ দিন পরও এই ঘোষণা অমর হয়ে ওঠে বাঙালীদের ভাষা আন্দোলনে আত্মদানের মাধ্যমে বাঙালীদের ২১শে ফেব্রুয়ারি আজ বিশ্বের মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। পূর্ব পাকিস্তানকে ছুঁড়ে ফেলে বাঙ্গালীরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছে বটে তবে আমার বাংলাদেশের আইন এবং আদালতের রায়ের ভাষার এখনও ইংরেজি ভাষার নিগড়ে আবদ্ধ কেন?
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি -সুদীর্ঘ ১৯ বছর। বাংলা একাডেমীর একুশের অনুষ্ঠানে উদ্ভোধনী ভাষণে ১৯৭১ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পন্ডিতেরা পরিভাষা তৈরী করবেন, তার পরে বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদেরা যত খুশী গবেষণা করুন, আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব, সেই বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।” বঙ্গবন্ধু এই ঘোষণা দেন অখন্ড পাকিস্তানের ওপর দাঁড়িয়ে। কিন্তু যখন আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র পেলাম এক মহান মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে, এক নতুন সংবিধান পেলাম স্বাধীন রাষ্ট্রের, তখন ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বরে গৃহীত সংবিধানে কি একই রকম দ্যোতনা দেখতে পেয়েছি? উত্তর নিঃসন্দেহে, ‘হ্যা’। বাংলা ভাষায় রচিত পৃথবিীর একমাত্র সংবিধান হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩-এ লেখা হলো-‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। তাহলে মহামান্য আদালতের রায় কেন বাংলা ভাষায় লেখা হয় না? আমাদের আদালত সমূহ কি তবে প্রজাতন্ত্রের বাইরে?
মায়ের ভাষায় আদালয়ের রায় লিখতে হবে। তার কারণ :-
প্রথমত: বিচার এর রায় লেখা হয় দেশের মানুষের জন্য। তারাই যদি আদালতের রায় সঠিকভাবে বুঝতে না পারে তবে রায় লেখার অর্থ কি? ন্যায়-বিচার প্রতষ্ঠিতি হয়েছে কনিা এটা বুঝবে কি করে মানুষজন? তাই মহামান্য আদালতের রায় সমূহ বাংলায় লিখতে হবে।
দ্বিতীয়ত: সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ও বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান লিখেছেন, “অনেকের ধারণা, বাংলায় লেখা হলে আমাদের রায় কেউ পড়বে না। আমাদের রায় পড়ার জন্য যেন সারা বিশ্ব রাত জেগে বসে আছে! যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের র্স্বাথ জড়িত এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক, সেসব দেশের বেশ কিছু লাইব্রেরিতে গিয়ে আমি দেখেছি, সেখানে বাংলাদেশের ল জার্নাল বা বই নেই বললেই চলে।” অথচ আমরা ধরেই নিয়েছি যে আমাদের মাননীয় আদালত সমূহের রায় পড়ার জন্য গোটা বিশ্ব যেন মাতোয়ারা হয়ে আছে। কি অদ্ভূত যুক্তি!
তৃতীয়ত: আমাদের আদালতে বিচারপ্রার্থীগণ বাঙ্গালী, আইনজীবীগণ বাঙালী, মহামান্য বিচারপতিগণও বাঙ্গালী কিন্তু আদালতের রায়ের ভাষা বাংলা নয়। রায় লেখার সময় আমরা কেন জানি নিজেদের বৃটিশ ভাবতে ভালবাসি। আর তাই ইংরেজীতে গট্ গট্ করে রায় লিখে ফেলি। আসলে বহুদিনের ঔপনিবেশিক মনস্তত্ব: এত সহজে ছাড়া কি যায়? ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক আদালত প্রথার পত্তন হয়েছিল বৃটিশদের মাধ্যমে সেই ১৭২৬ সালে তিনটি শহরে-চেন্নাই, মুম্বাই আর কলকাতায়। তখন থেকে জজ-ব্যারিস্টার শব্দগুলোর সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে। তো এখন এই রায় লেখার সময় কাজরি আর হাকিমের আদালতের চেয়ে জজের আদালত ভাবতে কার না ভাল লাগে? আর তাই মগজে বাংলার ভিত তৈরী করা খুবই জরুরী।
চতুর্থত: পরভাষায় আইন চর্চার ফলে আমরা আইনশাস্ত্রে স্বাভাবিক সহজতা লাভ করতে পারিনি, পারিনি তেমন কোন মৌলিক অবদান রাখতেও। বাংলায় ভাল মানের আইনের বই পাওয়া দুষ্কর। আবার ইংরেজীতে আইনের ওপর লেখা দেশী লেখকের বই এর সংখ্যা অপ্রতুল। তাহলে আমাদের আইনের শিক্ষার্থীদের আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অন্ধ বানিয়ে রেখেছি। বাংলা ভাষায় আইনের ওপর গবেষণাপত্র আমরা হেসে উপেক্ষা করে উড়িয়ে দেই। বড় বড় চোখ করে এই আমাদের মত আইনের শিক্ষকেরাই শিক্ষার্থীদের উপহাস করে বলি, “ইংরেজী জানো না, তবে আইন পড়তে এসেছো কেন?” কি করছি আমরা? কোমলমতি আইনের শিক্ষার্থীদের ইংরেজী বলা রোবটে পরিণত করতে পারলেই ভাবছি আমাদের শিক্ষক জীবন সার্থক। এটা অন্যায়। আদালতের ভাষা বাংলা হলে শিক্ষার্থীদের তাদের মাতৃভাষায় আইন শিক্ষা দানের মাধ্যমে আমরা তাদের জ্ঞানের বিস্তার সাধন করতে পারবো। আর তাই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,“কোনো শিক্ষাকে স্থায়ী করিতে গেলে, গভীর করিতে হইলে, ব্যাপক করিতে হইলে তাহাকে চিরপরিচিত মাতৃভাষায় বিগলিত করিয়া দিতে হয়। যে ভাষা দেশের সর্বত্র সমীরিত, যাহাতে সমস্ত জাতির মানসিক নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নিষ্পন্ন হইতেছে, শিক্ষাকে সেই ভাষার মধ্যে মিশ্রিত করিলে তবে সমস্ত জাতির রক্তকে বিশুদ্ধ করিতে পারে, সমস্ত জাতির জীবনক্রিয়ার সহিত তাহার যোগসাধন হয়। ”
পঞ্চমত: বিশ্বের অনেক দেশ রয়েছে যখোনে মাতৃভাষাতেই আদালতের রায় লেখা হয়। উদাহরণ হিসেবে আমরা জার্মানী, জাপান অথবা চীন দেশের কথা বলতে পারি। এসব দেশের আদালত নিজেদের মাতৃভাষাতেই রায় লিখে থাকে। তবে যে সমস্ত রায় সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র মনে করে যে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সে গুলো তারা অন্য ভাষায় অনুবাদ করে থাকে। তাহলে একই পদ্ধতি বাংলাদেশে অনুসরণ করতে সমস্যা কোথায়? বাংলাদেশের প্রায় শতকরা ৯৫ ভাগ রায় লেখা হয় দেশের মানুষরে জন্য। এসব রায় ইংরেজিতে লেখার প্রয়োজন কি? তবে বাকী যে শতকরা ৫ ভাগ রায় আন্তর্জাতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হবে শুধু সেই সমস্ত রায় ইংরেজিতে অনুবাদ করে নেয়া যেতে পারে। এর ফলে মায়ের ভাষায় আমরা আমাদের আদালতের রায়ও পাবো, আবার অন্যদিকে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রায় সমূহ তাদের আন্তর্জাতিক আমেজও হারাবে না।
ষষ্ঠত: এমন কিছু মামলা রয়েছে যা জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বর্পূণ। এ সকল মামলায় রায় বাংলাতে হওয়াই বাঞ্ছনীয় যাতে দেশের সকল মানুষ তা বুঝতে পারে অতি সহজেই। এ বিষয়ে ষোড়শ সংশোধনী মামলার হাই কোর্ট বিভাগের রায়ে মহামান্য বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামাল লিখেছেন,“স্বভাবতই সংবিধান সংক্রান্ত মামলা জাতির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই সব মামলার রায় থেকে জনগণ তাদের পবিত্র সংবিধানকে আরও বেশি গভীরভাবে জানতে এবং বুঝতে পারে। পূর্বতন ৪টি সংবিধান সংশোধন মামলাই বিচার বিভাগের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। উপরে উল্লিখিত ঐতিহাসিক মামলাগুলো ভবিষ্যৎ সকল সাংবিধানিক সংকটে আমাদেরকে পথ দেখাবে। এই ধরনের মামলা জাতির আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে। সে কারনে এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ মামলা সমুহের রায় পড়ার জন্য প্রতিটি নাগরিকের অসীম আগ্রহ।
সে প্রেক্ষিতে আমি মনে করি, এই ধরনের জনগুরুত্বপূর্ণ সম্পন্ন মামলা সমূহ, বিশেষ করে সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত মামলাসমূহ এবং যেসব মামলায় সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয় সেই সব মামলা সমুহের রায় অবশ্যই বাংলায় প্রদান করা ন্যায়সঙ্গত।”
১৯৯৮ সালের ১লা মার্চ ঢাকায় বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইন্সটটিউিটরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শখে হাসনিা দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন- “দেশের আদালতে … দেশের জনগনের ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে না, সে তো এক লজ্জাকর ব্যাপার। এ দুর্গতি যত তাড়াতাড়ি দূর হয়, তার জন্য সর্বোতভাবে আমাদের চেষ্টা করতে হবে।”
দেশের আদালতে দেশের জগণের ভাষা ব্যবহৃত হতে হবে। মায়ের ভাষায় আদালতের রায় লিখতে হবে। ইংরেজী ভাষার নগিড় ভেঙ্গে বাংলা ভাষাকে মুক্তি দিতে হবে কারণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর মত আজ তার সন্তানেরাও দিগ্বিদিক হুংকারে ঘোষণা করুক-
“আমি বাঙালি,
বাংলা আমার দেশ,
বাংলা আমার ভাষা।”
লেখক: প্রসিকিউটর, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও আইনের অধ্যাপক, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post