মোঃ ফয়জুল হাসানঃ
মিথ্যা সাক্ষ্য একটি ব্যাধির মতো যা আমাদের সমাজ ও আদালতের সাথে ভয়ঙ্কর ভাবে জড়িয়ে পড়ছে এবং এর ফলে বিচার ব্যাবস্থা দিন দিন জতিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। অনেক মামলায় পক্ষগন মামলার রায় নিজেদের পক্ষে নেয়ার জন্য মিথ্যা সাক্ষের আশ্রয় নেয়। মিথ্যা সাক্ষের ফলে সুবিচার বিঘ্নিত হচ্ছে ও ক্ষতিগ্রস্থ ব্যাক্তিগন তাদের ক্ষতির কোন সুফল (সঠিক বিচার) পাচ্ছে না। এসব ঘটনার (মিথ্যা সাক্ষের) ফলে মানুস দিন দিন সুবিচার বা ন্যায়বিচার পাওয়ার বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে যা আমাদের বিচার ব্যাবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ। কিন্তু এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের পথ আমাদের দেশের আইনেই বলা আছে। যদি কেউ প্রমান করতে পারে যে, কোন সাক্ষী যে সাক্ষ্য দিয়েছে টা মিথ্যা বা সত্য নয় তবে সেই সাক্ষীর শাস্তির ব্যাবস্থা আইনে বলা আছে। একজন সাক্ষী যখন কোন মামলায় সাক্ষী প্রদান করবে তখন তাকে অবশ্যই তাকে হলফ করেই সাক্ষ্য প্রদান করতে হবে (সাক্ষী আইনের ধারা ৫) এবং এর ফলে সে সত্যকে সত্য হিসেবে এবং মিথ্যাকে মিথ্যা হিসেবে তুলে ধরতে বাধ্য থাকবে।
সাক্ষ্য কখন মিথ্যা বলে গণ্য হবেঃ
বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১৯১ ও ১৯২ ধারায় বলা আছে কখন সাক্ষ্য মিথ্যা বলে গণ্য হবে, টা হল-
• সাক্ষ্য আইনের ধারা ৫ অনুসারে হলফ করার পর কোন ব্যাক্তি এমন কোন বিবৃতি প্রদান করে যা সে মিথ্যা বলে জানে বা যা সে সত্য বলে বিশ্বাস করে না, তবে সে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে বলে গণ্য হবে।
• একইভাবে যে ব্যাক্তি কোন বহি (পুস্তক) বা রেকর্ডে এমন কোন ঘটনা ঘটায় বা এমন কোন বিবরণী লিপিবদ্ধ করে বা কোন দলিল প্রণয়ন করে যা সে মিথ্যা বলে জানে বা কোন সরকারি কর্মচারীর সামনে কোন মিথ্যা লিপি বা মিথ্যা বিবরণী উত্থাপন করে তবে সেই ব্যাক্তি মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে বলে গণ্য হবে।
এইসব ঘটনা ঘটলে আমরা তাকে মিথ্যা সাক্ষ্য বলে গণ্য করতে পারি, তবে কোন ব্যাক্তি মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে বলে অভিযোগ তুললেই তা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না। এটা অবশ্যই প্রমান করতে হবে। এই ধরনের অভিযোগ প্রমান বা প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে নিম্নোক্ত বিষয় গুলি প্রমান করতে হবে-
• অভিযুক্ত ব্যাক্তি হলফ লইবার ফলে বা আইনের বিধানের ফলে সত্য কথা বলিতে বাধ্য ছিলেন।
• তদনুযায়ী তিনি কিছু বলিয়াছিলেন বা কিছু ঘোষণা করিয়াছিলেন।
• তিনি উহা স্বেচ্ছায় করিয়াছিলেন।
• উহা মিথ্যা ছিল।
• তিনি উহাকে মিথ্যা বলিয়া জানিতেন বা উহাকে সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিতেন না।
এইসব বিষয় যদি প্রমান করা যায় তবে অভিযুক্ত ব্যাক্তি মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে বলে গণ্য হবে এবং সেই ব্যাক্তি শাস্তির সম্মুখীন হবেন।
মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার শাস্তিঃ
কোন ব্যাক্তি যদি আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করে তবে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি অনুসারে তার নিম্নোক্ত ধরনের শাস্তি হতে পারে-
• কোন ব্যাক্তি যদি বিচার বিভাগীয় মামলার কোন পর্যায়ে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য দেন তবে তিনি ৭ বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং তদুপরি অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। (ধারা ১৯৩)
• যে ব্যাক্তি কোন ব্যাক্তিকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার উদ্দেশে মিথ্যা সাক্ষ্য দেন তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। (ধারা ১৯৪)
• যে ব্যাক্তি কোন ব্যাক্তিকে ৭ বছর বা এর ঊর্ধ্ব মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধে দণ্ডিত করার উদ্দেশে মিথ্যা সাক্ষ্য দেন তিনি ঐ অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। (ধারা ১৯৫)
• যে ব্যাক্তি কোন বিষয়কে মিথ্যা বলে জানার পরেও তা সত্য বলে ব্যবহার করেন তিনি মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার অনুরূপ শাস্তি ভোগ করবেন। (ধারা ১৯৮)
• যে ব্যাক্তি আইনত বাধ্য হওয়া সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে কোন অপরাধ গোপন রাখেন তিনি ৬ মাস পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে বা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। (ধারা ২০২)
• যে ব্যাক্তি ২০৩ ধারা অনুসারে সংঘটিত কোন অপরাধ সম্পর্কে মিথ্যা সংবাদ দিবেন তিনি ২ বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে বা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। (ধারা ২০৩)
এইসব শাস্তিগুলোর বাহিরেও দেওয়ানি কার্যবিধির মাধ্যমেও আমরা এর প্রতিকার পেতে পারি, যেমন-
• মানহানির মামলা করতে পারি।
• দেওয়ানি কার্যবিধির ৩৫ (ক) ধারা অনুসারে আদালত তার এখতিয়ারের সমাম ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দিতে পারেন।
মিথ্যা সাক্ষ্য এমন একটি বিষয় যা ন্যায় বিচারকে বিঘ্নিত করে এবং যেহেতু মিথ্যা সাক্ষের বিষয়টি প্রমান হলে শাস্তির ব্যাবস্থা আছে তাই আমাদের মিথ্যা সাক্ষ্য পরিহার করা উচিত।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, চতুর্থ বর্ষ, আইন বিভাগ, স্টামফোরড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।
ই-মেইলঃ hassan.foyzul@gmail.com
Discussion about this post