একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড দরজায় কড়া নাড়ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন আহমেদকে খুনের দায়ে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখা হয়েছে তার। একাত্তরে মীর কাসেমের নির্দেশেই চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিস সংলগ্ন এলাকায় মহামায়া ভবনে (ডালিম হোটেল) জসিমকে অপহরণের পর নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। জসিম হত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন। পরবর্তী সময়ে আপিলে ও রিভিউতেও ওই আদেশ বহাল থাকে।
২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগে জসিমসহ মোট আটজনকে হত্যার দায়ে মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছিলেন। সর্বোচ্চ আদালত তার আপিল আংশিক মঞ্জুর করে ১২ নম্বর অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দিয়েছেন। তবে ১১ নম্বর অভিযোগে জসিম হত্যার ঘটনায় সর্বোচ্চ সাজার রায়ই বহাল রয়েছে।
মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকা অভিযোগ ১১ নম্বরে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের পরের যেকোনও দিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের এক অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। তাকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যু হলে আরও পাঁচজন অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
পাশাপাশি ৪ ও ৬ নম্বর অভিযোগে সাত বছর করে সাজার রায় থেকেও জামায়াতের এই নেতাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।তবে আপিল নাকচ করে ২, ৩, ৭, ৯, ১০ ও ১৪ নম্বর অভিযোগে মোট ৫৮ বছর কারাদণ্ডের সাজা বহাল রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন একাত্তরের এই বদর নেতার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপারধের মোট ১৪টি অভিযোগ এনেছিল। তার মধ্যে ১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বর অভিযোগ থেকে ট্রাইব্যুনালের রায়েই খালাস পেয়ে যান কাসেম।
জসিমকে হত্যার এই অপরাধ ছাড়াও কারাদণ্ড পাওয়া ছয় অভিযোগগুলো হলো মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯ নভেম্বর দুপুর ২টার দিকে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও আলবদর বাহিনী লুতফর রহমান ফারুক ও সিরাজকে চাক্তাই এলাকার বকশিরহাটে জনৈক সৈয়দের বাড়ি থেকে অপহরণ করে। এরপর তাদের ডালিম হোটেলে নেওয়া হয়। পরে লুৎফর রহমান ফারুককে বাইরে নিয়ে গিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের কর্মীদের বাড়িগুলো চিহ্নিত করিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। বিজয়ের আগ পযন্ত ফারুককে সেখানে রেখে ও পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দিয়ে আটকে রাখা হয়। এ ঘটনায় মীর কাসেম আলীর ২০ বছরের কারাদণ্ড আপিলে বহাল রাখা হয়েছে।
তিন নম্বর অভিযোগে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ৭ বছরের কারাদণ্ড আপিলে বহাল রয়েছে। এ অভিযোগ মতে, একাত্তরের ২২ অথবা ২৩ নভেম্বর জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে ডবলমুরিং থানাধীন কদমতলীতে তার বাসা থেকে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে অপহরণ করে আলবদর বাহিনী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোকেরা। তাকে ডালিম হোটেলের নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে মীর কাসেমের উপস্থিতিতে নির্যাতন চালানো হয়। সাত নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ৭ বছরের দণ্ড বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ। যেখানে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৭ নভেম্বর মাগরিবের নামাজের পরে মীর কাসেমের নির্দেশে ডবলমুরিং থানাধীন ১১১ উত্তর নলাপাড়া থেকে মো. সানাউল্লাহ চৌধুরী, হাবিবুর রহমান ও ইলিয়াসকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে গেলে তাদের আটকে রেখে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়।
নয় নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরে ২৯ নভেম্বর মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে একই এলাকা থেকে পাঁচ চাচাতো ভাইসহ নুরুজ্জামানকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নেওয়া হয়। সেখানে তাদের আটকে রেখে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্যাতন করা হয়। এই অভিযোগে মীর কাসেম আলীকে দেওয়া ৭ বছরের দণ্ড আপিলেও বহাল আছে।
অভিযোগ ১০ অনুযায়ী মো. জাকারিয়া, মো. সালাউদ্দিন ওরফে ছুট্টু মিয়া, ইস্কান্দর আলম চৌধুরী, মো. নাজিম উদ্দিনসহ আরও অনেককে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করার বিষয় প্রমাণিত হওয়ায় মীর কাসেমকে দেওয়া ৭ বছরের কারাদণ্ড আপিল বিভাগে বহাল রয়েছে।
সর্বশেষ অভিযোগ ১৪ তে মীর কাসেমকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ১০ বছরের কারাদণ্ড বহাল রয়েছে। যে অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তর সালের নভেম্বর মাসের শেষ দিকে এ জে এম নাসিরুদ্দিনের বাড়িতে আশ্রয় নেন নাসিরুদ্দিন চৌধুরী। একদিন গভীর রাতে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে কয়েকজন আলবদর সদস্য ওই বাড়ি ঘিরে ফেলে নাসিরুদ্দীন চৌধুরীকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায় এবং সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন চালায়।
Discussion about this post