এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
যৌতুকের কারণে খুনসহ বীভৎস নারী নির্যাতনের চিত্র প্রায়ই চোখে পড়ে। আবার যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে নারীর আত্মহননের খবরও পত্রিকার পাতায় দেখা যায়। ‘কেরোসিন ঢেলে স্ত্রীকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে পাষণ্ড স্বামী’ এ রকম খবর প্রায়ই দেশের নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা দেয়। এখনও যৌতুকের কারণে জীবন দিতে হয় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মেডিক্যাল কলেজের মেধাবী কোন ছাত্রীকে।
যৌতুক এ দেশের একটি সামাজিক অভিশাপ। যৌতুক এখন আর গরিবের ঘরেই সীমাবদ্ধ নেই। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত বা ধনী পরিবারেও যৌতুকের ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়েছে। একটি বেসরকারী সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত ১০ বছরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ বিবাহিত নারী যৌতুকের কারণে শারীরিক অথবা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। দেশে নারী নির্যাতনের মাত্রা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেলে ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইন নামে একটি আইন প্রণীত হয়, যা এখনো বলবৎ আছে।
যৌতুক কি
বিয়ে উপলক্ষ্যে বর পক্ষ কন্যার কাছ থেকে বিয়ের আগে, বিয়ের সময়ে কিংবা বিয়ের পরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শর্ত আরোপ বা দাবি করে যে সমস্ত অর্থসামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদ বা অন্য যা কিছু আদায় করে তাকেই যৌতুক বলে।
১৯৮০ সনের যৌতুক নিরোধ আইন (৩৫ নং আইন) অনুযায়ী যৌতুকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, বিয়ের কোন পক্ষ অন্য পক্ষকে বর বা কনের বা কোন এক পক্ষের মা-বাবা কর্তৃক বা অন্য কোন ব্যক্তি কর্তৃক কোন পক্ষকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিয়ের সময় বা বিয়ের আগে বা বিয়ের পরে যে কোন সময় পণ হিসাবে প্রদত্ত বা প্রদানে সম্মত কোন সম্পত্তি বা মূল্যবান জামানতই হচ্ছে যৌতুক।
যৌতুক নেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যে নিবে বা যারা দিবে তাদের সবারই সাজা হবে। এ জন্য যৌতুক নেওয়ার অপরাধকে বলা হয়েছে জামিন অযোগ্য। যৌতুক নেওয়ার জন্য শাস্তি হবে ১ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দন্ডই হতে পারে। যে ব্যক্তি যৌতুক নেওয়া ব্যাপারে সহায়তা করবে তাদেরও একই রকম শাস্তি হবে এবং যে ব্যক্তি যৌতুক দাবি করবে তারও একই রকম শাস্তি হবে। এ ছাড়া যৌতুক গ্রহণের জন্য যদি কেউ উদ্বুদ্ধ করে বা প্ররোচিত করে সেই ব্যক্তিও ৩ ধারা অনুযায়ী অপরাধী হবে এবং তার শাস্তি হবে।
যৌতুকের জন্য মৃত্যু ঘটানো ইত্যাদির শাস্তি
যদি কোন নারীর স্বামী অথবা স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক, আত্মীয় বা স্বামীর পক্ষে অন্য কোন ব্যক্তি যৌতুকের জন্য উক্ত নারীর মৃত্যু ঘটায় বা ঘটানোর চেষ্টা করে কিংবা উক্ত নারীকে আহত করে বা আহত করার চেষ্টা করে তাহলে উক্ত স্বামী, স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক আত্মীয় স্বজনদের
১. মৃত্যু ঘটানোর জন্য মৃত্যুদন্ডে বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টার জন্য যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবে এবং উভয় ক্ষেত্রে উক্ত দন্ডের অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হবে।
২। আহত করার জন্য যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে বা আহত করার চেষ্টা করার জন্য অনধিক চৌদ্দ বৎসর এবং অন্যূন পাঁচ বসরের সশ্রম কারাদন্ডেও দন্ডনীয় হবে এবং উভয় ক্ষেত্রেই উক্ত দন্ডের অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হবে।
যৌতুকের জন্য মামলা দায়ের করতে হলে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট করতে হবে। প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট এই আইনানুযায়ী শাস্তি দিতে পারে। অপরাধ সংঘটনের তারিখ হতে ১ বৎসরের মধ্যে অভিযোগ করতে হবে। তা-না হলে সে অভিযোগ আদালত নিবে না অর্থাৎ সে অভিযোগের ভিত্তিতে অনিত মামলা তামাদি হবে। এ জন্য ঘটনার তারিখ থেকে এক বছরের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে।
যৌতুকের জন্য একজন নারী হত্যা ও দোষীদের খালাস পাওয়ার গল্প
কুষ্টিয়া ভেড়ামারার দরিদ্র পরিবারের মেয়ে বুলবুলি খাতুন। বিয়ে হয়েছিল একই এলাকার জনৈক ফরিদের সঙ্গে। ঘর সংসার করাকালীন অবস্থায় তাদের ঘরে জন্ম নেয় ফুটফুটে একটি কন্যা সন্তান। হঠাৎ ঘাতক ব্যাধি যৌতুক তছনছ করে দেয় বুলবুলির সুখের সংসার। মাত্র ২০ হাজার টাকা যৌতুকের জন্য এই অবলা নারীকে নির্মমভাবে গলায় শাড়ি পেচিয়ে হত্যা করা হয়। ২০০৭ সালের ৩০ এপ্রিল নিহত বুলবুলির পিতা জহুরুল মালিথা মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে ভেড়ামার থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় আসামী করা হয় নিহত বুলবুলির স্বামী ফরিদ, শ্বশুর, শ্বাশুড়ী, ননদ, ভাসুরসহ ৬ জনকে। মামলাটি হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১ এর খ ধারায়। নিহত বুলবুলির লাশ উদ্ধার করে ভেড়ামারা থানা পুলিশ কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে লাশের ময়নাতদন্ত করান। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেও মৃত্যুকে আঘাতজনিত ও নরহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ ডাক্তারী পরীক্ষায় বুলবুলিকে গলাটিপে হত্যা করার বিষয় প্রমাণিত হয়। রাসায়নিক প্রতিবেদনে মৃতের ভিসেরায় বিষ পাওয়া যায় এবং খুনের ঘটনা আসামি ফরিদের বাড়িতে সংঘটিত হয়। সে অনুযায়ী ঘটনার সাথে জড়িত সকল আসামী যাজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হবে- আইন এমনটিই বলে। কারন নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ১১ এর খ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো নারীর স্বামী অথবা স্বামীর পিতা-মাতা, অভিভাবক অথবা স্বামীর পক্ষের কোনো ব্যক্তি যৌতুকের জন্য কোনো নারীর মৃত্যু ঘটান, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যু ঘটানোর জন্য কিংবা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টার জন্য যাজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হবে। কিন্তু ওই মামলায় সকল আসামী খালাস পেয়েছে। কারন বুলবুলির বাবা অর্থ বা সম্পত্তির আশায় আসামিপক্ষে আপস সূত্রে সাক্ষ্য প্রদান করেন। তাই বিজ্ঞ আদালতের পক্ষে আসামিকে শাস্তি দেওয়া সম্ভব হয়নি। আদালতে সাক্ষী প্রদানের সময় বাদীপক্ষে বলা হয় যে, বুলবুলি মৃগীরোগী ছিলেন এবং সে কারণে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন। সাক্ষ্যে আরও উল্লেখ করা হয় যে ঘটনার তারিখ ও সময়ে আসামি ফরিদ বাড়িতে ছিলেন না। থানা-পুলিশ, বিচারক, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট নিশ্চয়ই আইনি সাক্ষ্যের মাধ্যমে অভিযোগ প্রমাণিত না হলে অপরাধীকে শাস্তি দিতে পারবেন না। যত দিন পর্যন্ত বিচারপ্রার্থী বিচারের জন্য না কাঁদবেন, তত দিন পর্যন্ত ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতেই কাঁদতে থাকবে।’
লেখকঃ সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, এম.ফিল গবেষক ও আইনজীবী জজ কোর্ট, কুষ্টিয়া। E-mail: seraj.pramanik@gmail.com.
Discussion about this post