জীবনের কোনো না কোনো সময় প্রায় সব নারী যৌন হয়রানির শিকার হন। তা আবার নানাভাবে। ছোটখাটো ঘটনা নারীরা উপেক্ষা করেন। বড় ঘটনাগুলো বড় ধরনের ক্ষত রেখে যায়। কেউ প্রতিবাদ করেন, কেউবা ভেতরে-ভেতরে গুমরে মরেন। উন্নত, অনুন্নত বা উন্নয়নশীল সব দেশেই চিত্রটা প্রায় এক।
মেয়েরা যারা কিশোরী বা তরুণী, তারাই বেশি যৌন হয়রানিতে বেশি পড়ে। মেয়েরা কীভাবে সাবধান হতে পারেন, পরিস্থিতি কীভাবে সামলাতে পারেন, তা নিয়ে প্রশিক্ষণ দরকার বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। হোয়াইট হাউস বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা বাধ্যতামূলক করেছে। অপরাধীদের প্রয়োজনমতো শাস্তিও দিতে পারবে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
এ বছরের ১ আগস্ট মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করে একটি আইন কার্যকর করা হয়েছে। ওই আইন অনুসারে, আগস্ট মাসের শুরুতেই মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ হাজার ৭০০ নতুন শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার প্রথম ১০ দিনের মধ্যেই শিক্ষার্থীরা এই প্রশিক্ষণ নেন।
মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন শিক্ষার্থী টনি বার্টন এই প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তিনি বলেন, তাঁর প্রশিক্ষণের বেশির ভাগ অংশজুড়েই ছিল উপস্থিত বুদ্ধি খাটানো। সবার ক্ষেত্রে যে একই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তা নয়। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ না করলে অনেকে প্রশ্রয় পায়। ভাবে, মেয়েটির এতে সম্মতি আছে। তাই সুকৌশলে প্রতিবাদ করার শিক্ষাটাও মেয়েদের দেওয়া হয়।
ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রথম যৌন হয়রানি প্রতিরোধ প্রশিক্ষণ আইন পাস হয়। গত বছর জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষার্থীদের জন্য যৌন হয়রানি প্রতিরোধ-বিষয়ক প্রশিক্ষণকে বাধ্যতামূলক করা হয়। যৌন হয়রানি থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে হোয়াইট হাউসের নিজস্ব টাস্কফোর্স রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধ-বিষয়ক বিভিন্ন জরিপ ও পরিসংখ্যান বলছে, নারী-পুরুষ একসঙ্গে থাকে—এমন সব জায়গায়ই কমবেশি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে। সে তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয় বেশি বিপজ্জনক, তা বলা যাবে না। যৌন হয়রানির পরিসংখ্যান সঠিকভাবে তুলে ধরাটা কঠিন। অ্যাসোসিয়েশনস অব আমেরিকান ইউনিভার্সিটিজ বলছে, স্নাতকপূর্ব শিক্ষার্থীদের ২৩ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপ বলছে, এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। ওই জরিপ বলছে, যৌন হয়রানির শিকার মেয়েরা কমই মুখ খোলেন। অনেক দ্বিধা ও সময় পেরিয়ে যখন তাঁরা প্রতিবাদ করেন, তখন অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
যৌন হয়রানির বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটে নতুন শিক্ষার্থীদের বেলায়। কলেজগুলোর আইনি পরামর্শ-বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ট্রেনইডির সহপ্রতিষ্ঠাতা ক্যাথরিন ন্যাশ বলেন, স্কুল শুরু হওয়ার সময়টা (পাশ্চাত্যে স্কুল শেষ করে কলেজে ঢোকার সময়টাই এ হিসেবে পরিচিত) বিশেষ করে থ্যাঙ্কসগিভিংয়ের মতো উৎসবগুলোতে এ ধরনের যৌন হয়রানি বেশি ঘটে। নতুন শিক্ষার্থীরাই যৌন হয়রানির শিকার বেশি হন। ন্যাশ বলেন, কৈশোর পার হওয়া এসব শিক্ষার্থী প্রথমবারের মতো অ্যালকোহল বা মদ্যপান করেন। ৭৫ শতাংশ যৌন হয়রানির ঘটনা মদ্যপ অবস্থায় ঘটে।
মিনেসোটার সেন্ট পলে সেন্ট থমাস ইউনিভার্সিটির ছাত্রী ভিক্টোরিয়া। সবেমাত্র সেখানে ভর্তি হয়েছেন তিনি। ভিক্টোরিয়ার মা শেরিল মরিসন বলেন, যৌন হয়রানির ঘটনা নেশাগ্রস্ত অবস্থাতে বেশি ঘটে। তবে অনেক শিক্ষার্থী মনে করেন, যৌন হয়রানির শিকার মেয়েটির ওপর দোষ চাপাতেই এমনটা করা হচ্ছে।
যৌন হয়রানির শিকার নারীদের পক্ষের আইনজীবী অ্যান অলিভারিয়াস মনে করেন, পর্নোগ্রাফি সহজলভ্য হওয়ায় যৌন হয়রানি বাড়ছে। শারীরিক ও মানসিক উত্তেজনার বশে কৈশোর পার হওয়া শিক্ষার্থীরা এমন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। স্মার্টফোনে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে যে কেউ যৌন হয়রানির ছবি ও ভিডিও সহজেই দেখতে পাচ্ছেন। এসব কারণে ছেলেদের মধ্যে যৌনচিন্তা ঢুকে যায়। মেয়েদের হয়রানি করার মাধ্যমে ছেলেরা যৌন প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে চেষ্টা করে। ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া যৌন হয়রানির ঘটনার খবরগুলোও প্রভাব ফেলছে।
অপরাধীরা যাতে সহজে পার পেয়ে না যায়, এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সতর্ক হতে বলেছে হোয়াইট হাউস। নাম উল্লেখ করে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে। অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয়কে জরিমানা করা হবে, নয়তো সতর্ক করা হবে।
হোয়াইট হাউস যা অনুমোদন করেছে, তা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অপরাধীকে শাস্তি দিতে পারবে। অপরাধের মাত্রা বেশি হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, ছাত্রত্ব বাতিলও (ক্যারিয়ার ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট) করতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তিনি সাবেক বিচারকদের ট্রাইব্যুনালে নিয়োগ দিয়েছেন। তাঁরাই অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা করছেন। দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে
Discussion about this post