খসড়া ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান নিয়ে রাজউক আয়োজিত দু’দিনের সেমিনারের শেষ দিন সোমবার (১৪ সেপ্টেম্বর) নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, পরিবেশবিদ, আবাসন ও ভূমি ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরা এ সমালোচনা করেন।
বক্তারা বলেন, ঢাকা শহর নিয়ে ষাটের দশক থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের পরিকল্পনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফলে ঢাকা বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।
যেকোনো শহরের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি উল্লেখ করে তারা বলেন, কিন্তু পরিকল্পনা অবশ্যই বাস্তবসম্মত হতে হবে। তা না হলে পরিকল্পিত, বাসযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব নগরী গড়ে উঠবে না।
খসড়া ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের অন্তর্ভুক্ত না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তারা বলেন, নির্ধারিত এলাকার (ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ) মেয়র, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, পেশাজীবী ও সংশ্লিষ্টদের অন্তর্ভুক্ত না করেই খসড়া পরিকল্পনা করা হয়েছে।
খসড়া এ প্ল্যান তৈরিতে তাড়াহুড়া না করে ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ও ৫টি পৌরসভার মেয়র, ৭০টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করার কথা বলেন বক্তারা। এ বিষয়ে উল্লিখিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে একটি বাস্তবসম্মত ঢাকা কৌশল পরিকল্পনা প্রণয়নের পরামর্শও দেন তারা।
একই সঙ্গে তারা ইতোপূর্বে ঢাকার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দুর্বলতা চিহ্নিত করে খসড়া ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান বাস্তবসম্মত করতে বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ বা নগর সরকার প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।
দু’টি ভাগে বিভক্ত সেমিনারে প্রথম অংশে রাজউকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী জি এম জয়নাল আবেদীন ভূইয়া সভাপতিত্ব করেন। দ্বিতীয় অংশে সভাপতিত্ব করেন নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।
সেমিনারে আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলাম নাজেম, রাজউকের রিজিওনাল ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিং (আরডিপি) বিশেষজ্ঞ জিনাত নাহারিন, অধ্যাপক ফরিদা নিলুফা ও এ টি এম নুরুল আমিন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সারওয়ার জাহান, অধ্যাপক ড. শহিদুল আমিন, ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ কে এনামুল হক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স’র (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক আকতার মাহমুদ, স্থপতি ইকবাল হাবিব, রাজউকের সদস্য (পরিকল্পনা) আব্দুর রহমান, বিআইপি’র সভাপতি ড. গোলাম রহমান, ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস’র (আইএবি) সভাপতি স্থপতি আবু সাইদ এম আহমেদ, রাজউকের সাবেক নগর পরিকল্পনাবিদ গোলাম হাফিজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কালাম, বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইশরাত ইসলাম, বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলডিএ) সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা কামাল মহিউদ্দীন, রিয়েল স্টেট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) প্রতিনিধি প্রকৌশলী মো. সোহেল রানা।
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানের যে বই ছাপা হয়েছে তার পরিবর্তন দরকার। ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায়ও বই ছাপাতে হবে। সব নগরায়ন পদ্ধতি থাকলে তা বুঝতে সহজ হবে। খসড়া পরিকল্পনায় এলাকাভিত্তিক ঘনত্ব উল্লেখ নেই। কনজারভেশন ঘোষণা করা হলে সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান বলেন, সবার অংশগ্রহণে একটি বাস্তাবায়নযোগ্য পরিকল্পনা করার কথা চিন্তা করতে হবে। এতে সংশ্লিষ্টদের অংশগ্রহণ থাকা উচিত। পৃথিবীর সব প্ল্যান হয় জনগণের জন্য। তাই সব জনপ্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে এ প্ল্যান করতে হবে। আমাদের অনেক অভিজ্ঞ লোকজন এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। রাজউকের উচিত তাদের প্ল্যানের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা।
অধ্যাপক ড. সারওয়ার জাহান বলেন, আমাদের একটি শহর হয়ে আছে। এখান থেকে লোকজন উচ্ছেদ করে প্ল্যান বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই প্ল্যান করার জন্য সব দিক মাথায় রাখতে হবে। তেমনি সব এলাকা নিয়ে ড্যাপ করা যাবে না। রাজউক আকাশকুসুম কল্পনা করে মানুষের ঘর-বাড়িকে খালি জায়গা বললেই তা মেনে নেবে না জনগণ।
স্ট্রাকচার প্ল্যান প্রণয়নে তড়িঘড়ি করা ঠিক হবে না মন্তব্য করে অধ্যাপক ড. ইশরাত ইসলাম বলেন, সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কাজ শুরু করলে ভালো হতো। যারা বিভিন্ন বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন, তাদের বিষয়ের কিভাবে সমাধান হলো তাও জানানো দরকার।
বিএলডিএ’র সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা কামাল মহিউদ্দীন বলেন, ১৯৬০ সাল থেকে পরিকল্পনা হচ্ছে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন দেখছি না। সম্প্রতি খসড়া ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান নিয়ে যে গণশুনানি হয়েছে তার এক সপ্তাহের মধ্যে সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। গণশুনানিতে হাজার হাজার অভিযোগ পড়ে। সেগুলো অন্তর্ভুক্ত না করলে গণশুনানি করার প্রয়োজন কি?
তিনি বলেন, অতীতে যেভাবে ড্যাপ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যদি আবারও তাই হয় এর ফলাফল কখনও ভালো হতে পারে না। এ কারণে আমরা সব মহল অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যাই। সবার মধ্যে একটি আত্মঅহমিকা বা আত্মমর্যাদার লড়াই সৃষ্টি হয়। যে কারণে এ প্ল্যান প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।
ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানেও কনজারভেশন জোন হিসেবে বিশাল এলাকার কথা বলা হয়েছে। তা কতোটুকু বাস্তবতার নিরিখে হয়েছে তা যাচাই বাছাইয়ের যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। ড্যাপে পানগাঁও পোর্ট, কেরাণীগঞ্জ নতুন কারাগারের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সরানোর কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে এসব সম্ভব নয়। তেমনি নতুন ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানে ঢাকা সেনানিবাসের মতো বিশাল স্থাপনা সরাতে বলা হয়েছে। যা বাস্তব সম্মত নয়, বলেন মোস্তফা কামাল মহিউদ্দীন।
প্ল্যান যদি সঠিক না হয়, তা হলে বাস্তবায়ন হবে কিভাবে- প্রশ্ন করে তিনি বলেন, আমরা খাল ভরাট নিয়ে অনেক কথা বলি। কিন্তু খাল উদ্ধার হচ্ছে না। খাল ও নদী উদ্ধারের জন্য কাজ করুন। আমরা কথা দিচ্ছি বিএলডিএ’র পক্ষ থেকে সবরকম সহযোগিতা করবো।
মোস্তফা কামাল মহিউদ্দীন আরও বলেন, ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানে প্লট ব্যবসাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। রাজউক থেকে নীতিমালা মেনে যারা দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করেছেন তারা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই আমাদের জোরালো দাবি, আগামী ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান ও ড্যাপ, যাই বলি না কেন, তা হতে হবে সময় উপযোগী, বাস্তবায়নযোগ্য। তাতে সবার অংশগ্রহণ থাকতে হবে।
রাজউকের সাবেক নগর পরিকল্পনাবিদ গোলাম হাফিজ বলেন, আমরা এক সময় মানুষের জমি দেখে প্ল্যান দিতাম। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে তা আজ সম্ভব নয়। ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানে কালীগঞ্জ পৌরসভাকে ড্যাপের আওতায় নিয়ে আসা যায়। এছাড়া কাঞ্চন ও সোনারগাঁও পৌরসভার কিছু এলাকা প্ল্যান থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করছি।
ভূমি ব্যবস্থাপনা ও ভূমি ব্যবহারকে আলাদা করা হলে ড্যাপ বাস্তবায়ন সহজ হবে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।
নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ২০ বছরের জন্য এমন কোনো পরিকল্পনা করা যাবে না, যাতে দুর্যোগ নেমে আসবে। খাল-বিল-নদী-নালা ভরাটের বিষয়ে আমাদের সমস্যা আছে।
তিনি বলেন, ১ হাজার ৬৪২ কিলোমিটার প্ল্যানের মধ্যে প্রতিটি বিষয়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করতে হবে। তাদের সম্পৃক্ত করতে না পারলে কোনোভাবেই এ প্ল্যান বাস্তবায়ন করা যাবে না। প্রয়োজনে নগর সরকার গঠনের বিষয়টিও এখন ভাবতে হবে।
স্থপতি ইকবাল হাবীব বলেন, খাল উদ্ধারের প্রয়োজন আছে। নদী বাঁচাতে সব ব্যবসায়ী বন্ধুদের নিয়ে ঐকমত্য তৈরি করা যেতে পারে। ঢাকার স্ট্রাকচার প্ল্যান সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত করতে হবে।
তিনি রাজউকের উদ্দেশ্যে বলেন, সবার অংশগ্রহণ ছাড়া ভুলেও খসড়া ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান পাস করানোর চিন্তা করবেন না। ভারসাম্যপূর্ণ সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে চরম মূল্য দিতে হবে।
রিহ্যাব পরিচালক প্রকৌশলী সোহেল রানা বলেন, ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান বিগত দিনের ড্যাপের মতো করলে তা কোনোভাবেই ঠিক হবে না। কনজারভেশন জোন হিসেবে যা চিহ্নিত করা হবে, তাদের ন্যায্যমূল্য দিতে হবে।
আলোচনা শেষে রাজউকের সদস্য (পরিকল্পনা) আব্দুর রহমান বলেন, সবার জন্য কল্যাণ হবে এমন চিন্তা করেই ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান করতে হবে। দু’দিনব্যাপী সেমিনারে যেসব প্রস্তাবনা এসেছে, তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আবারও আলোচনা করা হবে।
Discussion about this post