রফিকুল ইসলাম সবুজ:
সরকারি ও বিরোধী দলের অনড় অবস্থানের কারণে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান জাতীয় সংসদে হচ্ছে না। সংসদে আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কট সমাধানের জন্য প্রধান দুই দলের শীর্ষ নেতাদের প্রতি সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও এ ব্যাপারে সংসদের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি বলেন, সঙ্কট সমাধানে সরকারি ও বিরোধী দলকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কার্যত তার করার কিছু নেই। অন্যদিকে সরকারি দলের পক্ষ থেকেও সংসদে আলোচনার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কোনো প্রস্তাব থাকলে তা বিরোধী দলকেই সংসদে উত্থাপন করতে হবে। তখন তা নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছানো যেতে পারে। আর বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের বিল সরকারের পক্ষ থেকেই সংসদে আনতে হবে। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক বলেছেন, জটিলতা সরকার সৃষ্টি করেছে, তাই এর সমাধান তাদেরই করতে হবে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সংসদে কোনো প্রস্তাব আনা হবে না। সংসদের বাকি সময়ে তারা সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে এখনও অনড় রয়েছে। তাই সংসদে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে কোনো প্রস্তাব উত্থাপনের কোনো সুযোগ নেই। বুধবার সংসদের চলতি অধিবেশন আগামী ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত মুলতবি করা
হয়েছে। ২৪ অক্টোবরের পর সংসদের অধিবেশন আর বসবে না সংসদের কার্যউপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও এই সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আসতে পারে বলে জানিয়েছেন সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা। তারা জানান, ঈদ ও পূজার ছুটি বাদ দেওয়ার পর সংসদের অধিবেশন বসবে আর মাত্র ১০ থেকে ১২ কার্যদিবস। সংসদ সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ সময়ের মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে যে সঙ্কট, তার সমাধানের সুযোগ তেমন একটা নেই। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে দাবি বিরোধী দলের তা মানতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে সংবিধান সংশোধন সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন তারা। ফলে সঙ্কট থেকেই যাচ্ছে। আর এ ব্যাপারে সংসদের পক্ষ থেকে স্পিকারও কোনো উদ্যোগ নেবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। স্পিকার বলেছেন, সংসদ অধিবেশন চলাকালে রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে সংসদে এ বিষয়ে আলোচনার জন্য স্পিকার হিসেবে তিনি সুযোগ করে দিতে রাজি আছেন। তবে এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকেই উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি নিজের উদ্যোগে কিছু করবেন না। কারণ স্পিকার হিসেবে তার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ।
জাতীয় সংসদে সঙ্কটের সমাধান হবে এমনটা এতদিন বিভিন্ন মহল থেকে আশাবাদী থাকলেও এ পরিস্থিতিতে তা সম্ভব হচ্ছে না মন্তব্য করে বিশিষ্ট আইনবিদ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, সংসদের বাকি অল্প কয়েক কার্যদিবসে সংবিধান সংশোধন বা আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার সুযোগ আর নেই। এ সুযোগ মূলত জুন মাসেই শেষ হয়ে গেছে। এখন যে পরিস্থিতি তাতে একতরফা নির্বাচনের দিকেই এগোচ্ছে ক্ষমতাসীন দল।
এদিকে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা কী হবে তা নিয়ে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক জটিলতার অবসান না হতেই নতুন করে জটিলতা তৈরি হয়েছে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হলে পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে অধিবেশন বসতে পারবে কি না তা নিয়ে। বুধবার সংসদের বৈঠকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ ২৪ অক্টোবরের পরও সংসদ অধিবেশন চালাতে স্পিকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত অধিবেশন চালাতে সাংবিধানিক কোনো বাধা নেই। তার এই বক্তব্য সমর্থন করে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী ও দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও বক্তব্য রাখেন। দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ৫ বছরের একদিন আগেও সংসদ ভাঙার অধিকার কারও নেই। সংবিধান অনুযায়ী মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এ সময় সংসদ ভেঙে দিতে হবে তা কোথাও নেই। তাছাড়া নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা ছোট করতে হবে বা ভেঙে দিতে হবে এমন কথাও সংবিধানে নেই।
সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে, (ক) মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে এবং (খ) মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাঙিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে।’ যদিও এ অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়, ‘তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপ-দফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।’ অর্থাত্ নির্বাচনকালীন সময়েও সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা অব্যাহত থাকবে। তবে ১২৩ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হলে নির্বাচনকালীন ৯০ দিনের মধ্যে সংসদের অধিবেশন বসতে পারবে কি পারবে না এ বিষয়ে সংবিধানে কোনো ব্যাখ্যা নেই। এমনকি নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা কী হবে তাও বলা হয়নি। আইনবিদরা বলছেন সংবিধানে বিষয়গুলো পরিষ্কার উল্লেখ না থাকায় নানারকম জটিলতা তৈরি হবে। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকারের সঙ্গে ক্ষমতা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের মধ্যে রশি টানাটানি শুরু হবে।
বিশিষ্ট আইনবিদ ড. শাহদীন মালিক সকালের খবরকে বলেছেন, যদি ১২৩ (৩)-এর (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন হয়, তাহলে নির্বাচন কমিশনকে নতুন আচরণবিধি তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অসম প্রতিযোগিতা হবে প্রার্থীদের মধ্যে। তাই ১২৩(৩)-এর (খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকারের উচিত হবে সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যেই নির্বাচন করা। তাহলে অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতার যে অভিযোগ উঠেছে তা থাকবে না। তার মতে, সংসদ ভেঙে দেওয়ার আগে মৌলিক বিষয়ে সমঝোতা না হলে সাংবিধানিক সঙ্কট এবং নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হবে। সংসদের চলতি অধিবেশনে এ সমস্যার সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা আর না থাকায় সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে দেশ।
বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের পর নতুন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত সপদে বহাল থাকবেন প্রধানমন্ত্রী। সংসদ ভেঙে দেওয়া না হলে পদে থাকবেন সংসদ সদস্যরাও। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সকালের খবরকে বলেছেন, সংসদ বহাল রেখে পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হলে এ ক্ষেত্রে এ সময়ে সংসদের অধিবেশন চালাতে সাংবিধানিক কোনো বাধা নেই। কারণ পূর্ববর্তী ৯০ দিনে সংসদের অধিবেশন বসতে পারবে না তা সংবিধানে উল্লেখ নেই। তাই সংসদের মেয়াদকালের মধ্যে যে কোনো দিন সংসদের বৈঠক বসতে পারবে।(সকালের খবর)
Discussion about this post