তানবীর চৌধুরী:
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান আমাদেরকে চলাফেরার স্বাধীনতা দিয়ে থাকে। “বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, ইহার যে কোন স্থানে বসবাস ও বসতিস্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার” সংবিধানের ৩৬ নাম্বার অনুচ্ছেদ থেকে আমরা পেয়ে থাকি। তবে একটা শর্ত থাকে যে, “এই অনুচ্ছেদের সকল সুযোগ সুবিধা জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে উপভোগ করতে হবে”। এখানে জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ বলতে বুঝানো হয়েছে যে, জনস্বার্থে যদি কোন আইনের মাধ্যমে যুক্তিসঙ্গতভাবে কোন বাধা-নিষেধ করা হয়, তাহলে এই অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করা যাবে না। “সংরক্ষিত এলাকা” নামে এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে এই অনুচ্ছেদ প্রয়োগ হবে না। কেননা, আইনের দ্বারা আরোপিত নিষেধ রয়েছে বলেই, সেখানে সাধারণ জনগণ যাওয়া নিষেধ। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার ফার্মগেট সংলগ্ন তেজগাঁও কলেজের বিপরীতে পার্কটি অনেক মানুষের বিশ্রাম/বিনোদনে স্থান। কিন্তু সন্ধ্যার পর এখানে আইনত প্রবেশ নিষেধ, এখানে ৩৬ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করে জোরপূর্বক প্রবেশ করা যাবে না। তাছাড়াও আরও অনেক স্থানে সবার প্রবেশ কিংবা চলাফেরায় স্বাধীনতা থাকে না, এটা সম্পূর্ণই আইনের দ্বারা নির্দেশ। কিন্তু যেই সব স্থানে জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ নেই, সেই সব স্থানে কোন প্রকার অনুমতি ছাড়াই চলাফেরা করার স্বাধীনতা স্বয়ং সংবিধানই দিচ্ছে। অতএব, যেকোন ব্যক্তি যেকোন সময় তার এই অধিকার চর্চা করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে কি সবাই তার এই অধিকার ভোগ করতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই বলবে, হ্যাঁ, আমি আমার এই অধিকার সম্পূর্ণরূপে উপভোগ করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে অনেকেই যে তার এই অধিকার উপভোগের বিপরীতে কেলানো খেয়েছে তার অনেক জীবন্ত স্বীকারউক্তি রয়েছে। উদাহরণটা অতি সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা। ঘটনা সত্য হলেও স্থানের নামটি উল্লেখ্য করা হচ্ছে না।
ঘটনাটি মূলত, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া হোস্টেলে থাকা ৩টি ছেলের স্বীকারউক্তি। এর আগে বলা ভালো, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রদের সন্ধ্যাই হয় সাধারণত মাঝ রাতে। আড্ডা, কার্ড, ফোনে কথা, টিভি, ফেসবুক ইত্যাদি শেষে সময় থাকলে পড়ালেখা। এই ৩ জনও তার ব্যতিক্রম নয়। ঘটনার শুরু এখান থেকে, রাত তখন আনুমানিক ৩ টা। গভীর রাত বলা ঠিক হবে না, বলা উচিত রাতের শেষার্ধ। ৩ বন্ধু সবকাজও পড়ার শেষে চা খাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামলো। এত রাতে চা দোকান খুজে পাওয়াটা অনেক মুশকিল। খুজতে খুজতে যখন আর চা দোকান পেল না, তখন হতাশায় বাসায় ফিরে আসছিল সবাই। প্রধান রাস্তা ছেড়ে যখন গলির রাস্তায় নামল, তখনি হঠাৎ একটা মাইক্রো তাদের পিছনে চলে এল, আর তাদের ডাক দিল। তারা ডাকে সাড়া দিয়ে ৩ বন্ধুই সামনে গেল। মাইক্রো থেকে একজন নেমে এসে বলল, এত রাতে এখানে কি? উত্তরে তারা বলল, স্যার আমরা হোস্টেলে থাকি, চা খেতে বের হয়েছিলাম। স্যার একটা অকথ্য ভাষায় গালি(শূয়রের বাচ্চা) দিয়েই, সব কয়টার গালে গ্যাচাং গ্যাচাং করে চড় বসিয়ে দিল। কিছু বুঝে উঠার আগেই আরেকজন লোক ভিতর থেকে একটা লাঠি নিয়ে হাতে পায়ে ১/২ টা করে বসিয়ে দিল। তখন ভিতর থেকে একজনের মৃদু কণ্ঠে শুনা গেল যে, এরা দৌড়াচ্ছে না কেন। এটা শুনে তারা কিছুটা সাহস পেয়ে দৌড়ে বাসার দিকে চলে আসলো। সিভিল পোশাকে থাকার কারনে, ৩ জনের ধারনা হচ্ছে, স্যাররা আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্য। সন্ত্রাসী না এটা নিশ্চিত, কেননা সন্ত্রাসী হলে তাদের টাকাপয়সা/মোবাইল নিতে চাইত। যাক, এখন কথা হল, রাস্তাঘাটে চলাফেরার স্বাধীনতা তো সবার সব সময় আছে। কেবলমাত্র, জরুরী অবস্থা জারি থাকা অবস্থা সংবিধানের ৩৬-৪০ও৪২ নাম্বার অনুচ্ছেদ অকার্যকর থাকে। এখনতো জরুরী অবস্থাও নাই। তাহলে পাঠকের কাছে প্রশ্ন রয়ে গেল, রাত বাড়ার সাথে সাথে মানুষের মত সংবিধান নিজেও কি ঘুমিয়ে পড়ে?
লেখক: শিক্ষার্থী, দ্বিতীয় বর্ষ, আইন বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post