নিজস্ব প্রতিবেদক: রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় দায়ের করা চার মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে কেবল একটির। গত ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬ সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগে দায়ের করা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি মামলার রায় ঘোষণা করেন। বাকি তিন মামলার বিচারকাজ ঝুলে আছে। এর মধ্যে হত্যা মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে । আর ইমরাত নির্মাণ আইনে দায়ের করা দুই মামলার মধ্যে রাজউকের মামলাটি ঢাকার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এবং ইমারত নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের করা মামলাটি ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন। আরও ১১টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম আদালতে।
২০১৩ সালের এ দিনে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকার রানা প্লাজার আট তলা ভবন ধসে পড়ে। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে নিহত হয় ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক। আহত হন আরও কয়েক হাজার শ্রমজীবী মানুষ।স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাণঘাতী এই দুর্ঘটনার রেশ এখনও বয়ে চলছেন আহত শ্রমিক এবং হতাহততের পরিবারের সদস্যরা। আহত শ্রমিকদের বড় একটি অংশই এখনও ফিরতে পারেননি স্বাভাবিক জীবনে, কেউ আবার পঙ্গু হয়েছেন আজীবনের জন্য। এ ঘটনায় একাধিক মামলা দায়ের করা হয়।
রানা প্লাজা হত্যা মামলা: রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন এক হাজার ১৩৬ জন। আহত হয়েছিলেন আরও সহস্রাধিক শ্রমিক। এ ঘটনায় পরদিন সাভারথানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ ভবন নির্মাণে ‘অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যার অভিযোগে মামলাটি দায়ের করেন।
২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় অভিযোগ পত্রে ৫৯৪ জনকে সাক্ষী করা হয়।আসামি ৪১ জনের মধ্যে আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন মারা যান। দুজনকে বাদে বর্তমানে আসামির সংখ্যা ৩৯ জন। ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করলেও এখন পর্যন্ত একজনেরও সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়নি।
জেলা ও দায়রা জজের পাবলিক প্রসিকিউটর খোন্দকার আবদুল মান্নান বাংলাট্রিবিউনকে বলেন, হত্যা মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে জেলা ও দায়রা আদালতে।তবে মামলাটি উচ্চ আদালতে স্থগিত থাকায় বিচারকার্য শুরু করা যাচ্ছে না। আদালতের অনুমতি পেলে এ মামলার কার্যক্রম শিগগির শুরু করা যাবে। ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের এডিশনাল পাবলিক প্রসিউকিউশন মো. মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, হত্যা মামলাটি সাক্ষ্য পর্যায়ে রয়েছে । মামলায় উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় সাক্ষ্য গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না। রাষ্ট্রপক্ষে থেকে বারবার সাক্ষী হাজির করা হলেও সাক্ষ্য নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। মামলা বিচার এগিয়ে নেওয়ার জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল কাছে একটি আবেদনপত্র পাঠানো হয়েছে। এই দুই আসামি বাদে মামলার কার্যক্রম শুরু করার জন্য। কিন্তু এখানো সেই আবেদনের উত্তর এখানো আমাদের হাতে এসে পৌছায়নি। আশা করি উচ্চ আদালতের অনুমতি পেলেই বিচারকার্য দ্রুত শুরু করতে পারবো। মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ২৩ মে দিন ধার্য আছে। তিনি আরও বলেন, মামলাটিতে মোট আসামির সংখ্যা ৪১ জন। ২ জন মারা গেছে, বাকি ৩২ জন আসামি রয়েছে জামিনে । এদের মধ্যে ৭ জন পলাতক। বর্তমানে শুধু রানা কারাগারে রয়েছে।
ইমারত আইনে রাজউক ও দূর্নীতির মামলা: আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন ওইদিন ইমারত নির্মাণ আইনে সাভার থানায় আরেকটি মামলা করেন। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ১৩০ জনকে মামলার সাক্ষী করা হয়। পরে ২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। তবে এখন পর্যন্ত একজনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আনারুল কবির বাবুল বলেন, ‘কিছু আসামি অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিভিশন মামলা করেন।রিভিশন মামলাটি ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। রিভিশনের বিষয়টি নিষ্পত্তি হলে মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করতে পারব।’
এছাড়া, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পরপরই ভবন নির্মাণে দুর্নীতির অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ছয় তলার জন্য অনুমোদন নিয়ে ৮ তলা হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছিল রানাপ্লাজাকে। এই দুর্নীতির কারণে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা ও দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় সাভার থানায় ২০১৩ সালের ১৫ জুন একটি মামলা দায়ের করে দুদক। ২০১৪ সালের ১৬ জুলাই রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও দুদকের উপপরিচালক মফিদুল ইসলাম।
জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের অর্জনে দুদকের মামলা: ২০১৫ সালের ১২ এপ্রিল দুদকের সহকারী পরিচালক মাহবুবুল আলম বাদী হয়ে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা ও তার মা মর্জিনা বেগমের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় রানা প্লাজার নির্মাণের তথ্য গোপন করে দুদকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য দিয়ে ছয় কোটি ৬৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯০০ টাকা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করার অভিযোগ করা হয়। গত ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট এ মামলার রায় দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬-এর বিচারক কে এম ইমরুল কায়েস।দুদকের দায়ের করা এই মামলার রায়ে সোহেল রানাকে তিন বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ের আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই মামলায় তার মা মর্জিনা বেগমকেও তিন বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একইসঙ্গে অবৈধভাবে অর্জিত সাভার বাজার রোডের ৬৯/১ বাড়িটির এক-তৃতীয়াংশ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করারও আদেশ দেন আদালত।
শ্রম আইনে মামলা: এ ঘটনায় রানা প্লাজা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শ্রম আইনে ১১টি মামলা দায়ের করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর। সবগুলো মামলাই বিচারাধীন রয়েছে।
রানা প্লাজা ধসের মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনার ৬ বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০১৩ সালের এ দিনে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকার রানা প্লাজার আট তলা ভবন ধসে পড়ে। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় এক হাজার ১৩৮ জন শ্রমিক-কর্মচারী নিহত হন। আহত হন অন্তত ২ হাজার শ্রমিক। এদের অনেকেই সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। ছয় বছর পার হয়ে গেলেও এ ঘটনায় হতাহত শ্রমিক ও তার স্বজনেরা সুবিচার পাননি। বিচার হয়নি অভিযুক্তদের। মামলাগুলোর তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। অন্যদিকে, নিহত শ্রমিকদের স্বজনেরা যেমন যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাননি, তেমনি যথাযথ সহায়তা না পাওয়ায় আহত অনেক শ্রমিকই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিয়ে আজও ফিরতে পারেননি স্বাভাবিক জীবনে।
Discussion about this post