বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী জনগণই হল প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক। সুতরাং রাষ্ট্রের সকল তথ্য জানার অধিকার তাদের আছে। তথ্য অধিকার জনগণের ক্ষমতায়নের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। তাই জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা আবশ্যক। জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা হলে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারি ও বিদেশি অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারি সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে দুর্নীতি হ্রাস পাবে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। এছাড়া বাংলাদেশের সংবিধানে চিন্তা, বিবেক ও বাক-স্বাধীনতা এবং তথ্য প্রাপ্তি নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত।
সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়, তাই গণতন্ত্রের স্বার্থেই তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সরকারের ভুল-ত্রুটি দেখিয়ে দিয়ে সংবাদপত্রই পারে সরকারকে দায়িত্ববান করতে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশে সংসদ ছিল না। কিন্তু সেই সময় গণমাধ্যম সংসদের ভূমিকা পালন করেছিল এটা অনেকেই স্বীকার করে থাকেন। তাছাড়া বর্তমান সরকারের আমলে যখন বিরোধী দল দিনের পর দিন সংসদে উপস্থিত থেকে সরকার দলকে স্বেচ্ছাচার হবার মত সুযোগ সৃষ্টি করেছে, তখন বিরোধী দলের জায়গাটিও গণমাধ্যমই গ্রহণ করেছে বলে মনে করা হয়।
এটা প্রমাণিত যে, তথ্য চাওয়া ও এর প্রবাহ সচল করলেই সমাজের সব স্তরে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি সুশাসনের দু’টি প্রধান উপাদান। বিশ্বের যেসব দেশে তথ্য অধিকার আইন বলবৎ রয়েছে, সেখানে গণমাধ্যম বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলেছে। তাই গণমাধ্যমকে যদি বিশেষ ইতিবাচক ভূমিকায় দেখতে চাওয়া হয়, তাহলে তথ্য পাবার বিষয়টিকে শুধুমাত্র কাগুজে বিধান হিসেবে ফেলে না রেখে, তাকে প্রকৃত অর্থেই কার্যকর করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে যে সব বাধা আছে সেগুলো চিহ্নিত করে অপসারণ করার জন্য পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।
দেশের একটি অন্যতম সমস্যার নাম হলো দুর্নীতি, যা একটি দুষ্ট ক্ষতের মত। আর এই ক্ষতটি দিনের পর দিন বেড়ে গিয়েছে তথ্য গোপন করার সুযোগ নিয়ে। তথ্যের প্রবাহ স্বচ্ছ না হলেই সাধারণত দুর্নীতি বেড়ে যায়। তাই দুর্নীতি নামের দানবটিকে দমন করার জন্যও অবাধ তথ্য প্রবাহ একটি বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে। আর তা না হলে সমাজে অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, তা আজ প্রমাণিত। এছাড়া এর অভাবে জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহিতার জায়গাটিও হালকা হয়ে যায়। কারণ, জনগণ যখন তার প্রয়োজনীয় তথ্যটি চেয়েও পায়না, তখন তারাই যে রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক এ বিশ্বাসে ঘাটতি দেখা দেয়। মূলত এই সব কারণেই বলা হয়ে থাকে অবাধ তথ্য প্রবাহ গণতন্ত্রের ভিতকেই শক্তিশালী করে।
আজ তাই এ ধারণা গড়ে উঠেছে যে, গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চার লক্ষে তথ্যকে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। সরকার যদি সত্যিই দুর্নীতি দমনে আন্তরিক হয়, তবে তার উচিত ‘সরকারি গোপন তথ্যের’ অহেতুক আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা। শুধু সরকারি আয়-ব্যয়ই নয় বরং দাতা দেশগুলোর সাহায্য এবং ঋণদাতাদের সঙ্গে সরকারের চুক্তিসহ যাবতীয় বিষয়েও জনগণের জানার অধিকার নিশ্চিত করা দরকার। আর সেটা শুধুই বর্তমান সময়ের মত কাগুজে নয়, বরং বিষয়টি হওয়া উচিত এমন যে, ‘যেখানে সরকার চাহিবামাত্র জনগণকে প্রয়োজনীয় তথ্য জানাতে বাধ্য থাকবে’।
আর এর মাধ্যমে শুধু জনগণই নয়, রাষ্ট্রও উপকৃত হবে। কারণ, জনগণ যদি সরকারের কাজকর্ম সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত হয়, তাহলে সে হয়ে উঠবে আরও সচেতন। আর গণতান্ত্রিক সমাজে জনগণ তাদের অধিকার বিষয়ে সচেতনতার পাশাপাশি দেশের প্রতি, এই সমাজের প্রতি নিজেদের ভূমিকা অধিক দায়িত্বশীলতার সঙ্গে পালন করতে পারবে। অন্যদিকে, তথ্য গোপন করা হলে সরকার ও জনগণের মধ্যে যে দূরত্ব এবং শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা মানুষের কর্মস্পৃহাকেই কমিয়ে দেয় সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশের জনগণ দীর্ঘদিন ধরে তথ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার জন্য দেশে তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছিল। শেষ পর্যন্ত বহু কাঙ্ক্ষিত তথ্য অধিকার আইন পাওয়া গেছে। আশা করা হয়েছিল, এই আইন দীর্ঘদিন ধরে দেশের মানুষের মধ্যে গড়ে উঠা গোপনীয়তার সংস্কৃতি ভাঙতে সাহায্য করবে, জনগণকে ক্ষমতায়িত করবে এবং রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু বর্তমানে মিডিয়ার ওপর নানা বিধি-নিষেধ আরোপের মাধ্যমে সরকার জনগণকে সেই তথ্য প্রাপ্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে।
কাগুজে তথ্য অধিকার আইন
সরকার তথ্য অধিকার আইন পাস করে সুধী মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। কিন্তু বিনা কারণে সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজ এবং শীর্ষ নিউজ ডটকমের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করায় প্রশ্ন উঠেছে সাংবাদিকরা যেখানে তথ্যের উৎসের কাছেই যেতে পারছেন না, সেখানে তথ্য অধিকার আইনের যৌক্তিকতা কোথায়? সচিবালয় সরকার পরিচালনার অন্যতম একটি স্থান যেমন, তেমনি ঠিক এখান থেকেই রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় দুর্নীতিগুলো পরিচালিত হয়। আর সেই সচিবালয়ে দু’টি জনপ্রিয় মিডিয়ার সাংবাদিকের প্রবেশাধিকার কেড়ে নিয়ে সরকার তথ্য অধিকার আইনটিকেই হাস্যকর এবং একটি কাগুজে আইনে পরিণত করেছেন।
২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে তথ্য অধিকার বিষয়ক অ্যাক্ট পাস হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যাওয়ার পর এই অ্যাক্টটি আইনে পরিণত করা হয়। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার তথ্য অধিকার আইন পাস করার মাধ্যমে যুগোপযোগী একটি কাজ সম্পন্ন করে বলে সচেতন মহলের প্রশংসাপ্রাপ্ত হয়। তথ্য অধিকার আইন পাস করার পর সবাই আশ্বস্ত হয়েছিল এইবার হয়ত সত্যিকার অর্থেই গণমাধ্যম স্বাধীন হল। মিডিয়াগুলোতে প্রত্যাশা বাড়তে থাকে এ আইনটি কার্যকর হওয়ার পর বাংলাদেশ হয়ত এক নতুন যুগে পদার্পণ করল। কিন্তু মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই এ নিয়ে মানুষের মধ্যে নানা সংশয়ের জন্ম হতে শুরু করে। আইনটি পাসের মাধ্যমে মিডিয়াগুলোর দীর্ঘদিনের চাওয়া পূরণ হয়েছে সত্য। কিন্তু এর সুফল জনগণ এবং মিডিয়াগুলো পুরোপুরি ভোগ করছে কিনা সেটাই একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, নতুন তথ্য অধিকার আইন সেভাবে কার্যকর হতে দেখা যায়নি কোথাও। আইনটি পাসের পর দীর্ঘ সময় পরও তৃণমূল পর্যায়ের সাধারণ নাগরিকরা সরকারি বা বেসরকারি কোনো দফতর থেকেই প্রয়োজনীয় কোনো তথ্য পান না। অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টের কথা বলে সরকারি অফিসগুলোতে এখনও তথ্য লুকানো হয়। তাই আইন থাকলেও এখনও তার বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়নি। তাছাড়া এ আইন পাসের মাধ্যমে তথ্য গোপনের কুসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ তৈরি হলেও দেশের সাংবাদিক মহলের জন্য আইনটি খুব বেশি সহায়ক হয়েছে কিনা সেটাও একটি প্রশ্ন। কারণ, আগে তথ্য প্রকাশে নানা আইনি বাধা থাকলেও নিজস্ব ব্যবস্থায় সাংবাদিকরা ঠিকই তথ্য সংগ্রহ করে নিতো। কিন্তু বর্তমানে এই আইন পাসের পর একই তথ্য পেতে আবেদন করে, ২০ দিন এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে ৩০ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই এরপর আর ওই তথ্যের কোন গুরুত্ব থাকে না। এভাবেই তথ্যের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এক দুষ্ট চক্রের আবর্তে পড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে।
লেখকঃ অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক,সাংবাদিক, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, এম.ফিল গবেষক ও আইনজীবী জজ কোর্ট, কুষ্টিয়া। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com
Discussion about this post