তিনটি হাসপাতাল ঘুরেও চিকিৎসা না পেয়ে রাস্তায় সন্তান প্রসব এবং নবজাতক মারা যাওয়ার ঘটনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, এটা (প্রতিবেদন) দেখলে মনে হবে তাদের কোনো দোষ নেই। স্টাফদের কত সাফাই গাওয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এই প্রতিবেদন উপস্থাপন করার পর আদালত ওই প্রতিবেদনকে অস্পষ্ট ও স্ববিরোধী এবং গোটা প্রতিবেদনই প্রশ্নবিদ্ধ বলে মন্তব্য করেন।
আদালত তখন বলেন, এ প্রতিবেদন দেখলে মনে হবে তাদের (ঢামেক হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও স্টাফ) কোনো দোষ নেই। সব দোষ ওই বেচারা গরিব মানুষটির। গরিবের সঙ্গে এরকম আচরণ? তারা কি চিকিৎসা পাবে না?
গতকাল সোমবার (১৩ নভেম্বর) হাইকোর্টের বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহ’র সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এসব মন্তব্য করেন।
পরে আদালত আগামী ২৭ নভেম্বর পরবর্তী আদেশের দিন ধার্য করেছেন। ঢামেক হাসপাতালের তিন সদস্যের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার পর তা দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেন আদালত।
আদালতে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তাপস কুমার বিশ্বাস।
এদিকে দৈনিক যুগান্তর ও এশিয়ান এইজ পত্রিকাকে এ বিষয়ে প্রতিবেদনের সত্যতা নিশ্চিতে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
হাইকোর্ট গত ১৯ অক্টোবর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রাস্তায় সন্তান প্রসবের ঘটনা তদন্ত করতে ঢামেক হাসপাতাল এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের পরিচালক এবং আজিমপুর মাতৃসদনের তত্ত্বাবধায়ককে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন। অন্তবর্তীকালীন এ নির্দেশনার পাশাপাশি রুল জারি করা হয়।
রুলে ওই ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হবে না এবং ওই প্রসূতিকে কেন পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে নিয়ে এ আদেশ দিয়েছিলেন আদালত।
এ নির্দেশের পর ঢামেক হাসপাতদালের সহকারী পরিচালক (অর্থ ও স্টোর) ডা. মো. খলিলুর রহমানকে চেয়ারম্যান ও আবাসিক সার্জন (গাইনি ও অবস) ডা. রওশন আরাকে সদস্য সচিব করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অপর সদস্য হলেন আবাসিক সার্জন (ইমারজেন্সি ও ক্যাজুয়ালটি) ডা. মো. আলাউদ্দিন। এ কমিটি গত ৭ নভেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দেয়।
এছাড়া মিটফোর্ড হাসাপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আবদুস সালামকে সভাপতি এবং সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. সাফিয়া আখতারকে সদস্য সচিব করে চার সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি করে। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন-গাইনি বিভাগের ডা. আয়শা সিদ্দিকা ও রুমি নাহরীন। এ কমিটি আজ প্রতিবেদন জমা দেয়। এ প্রতিবেদন দুটি আদালতে উপস্থাপন করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল।
ঢামেক হাসপাতালের প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো নার্স বা স্টাফ টাকা দাবি করেনি। ওই প্রসূতির অবস্থা প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। তাই তাকে নরমাল প্রসবের জন্য অপেক্ষা করতে পরামর্শ দেন কর্তৃব্যরত চিকিৎসক। কিন্তু তারা কাউকে কিছু না জানিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে যায়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এ কমিটি আজিমপুর মেটারনিটিতে তদন্ত করেছে। সেখানে বেলা ১১টায় স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে বলে তদন্ত কমিটি জানতে পেরেছে।
এ প্রতিবেদন দেখে আদালত ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আদালত বলেন, তাদের এখতিয়ার নেই আজিমপুর মেটারনিটিতে তদন্ত করার। আর আজিমপুর মেটারনিটিতে স্বাভাবিক প্রসব হয়নি। রাস্তার ওপর প্রসব হয়েছে। সুতরাং এ তদন্ত প্রতিবেদন বানোয়াট, স্ববিরোধী ও অস্পষ্ট।
আদালত ঢামেক হাসপাতাল ও মিটফোর্ডের প্রতিবেদনে ওই প্রসূতি ভর্তির বিষয়ে যে সময়ের কথা উল্লেখ রয়েছে তা দেখে বিষ্ময় প্রকাশ করে বলেন, একটি সরকারি হাসপাতাল থেকে আরেকটি সরকারি হাসপাতালে রোগী কি উড়ে গেছে যে এত অল্প সময়ে পৌঁছে গেছে? ঢামেক হাসপাতালের প্রতিবেদন কত সুন্দর। এটা দেখলে মনে হবে তাদের কোনো দোষ নেই। স্টাফদের কত সাফাই গাওয়া হয়েছে।
আদালত বলেন, স্বাভাবিক প্রসব যদি হবে আর প্রাথমিক পর্যায়ে যদি থাকবে তাহলে রাস্তায় কেন প্রসব করল? এ থেকে ধরে নিতে হবে যে এ প্রতিবেদন সত্য না? ভর্তির যে ফরম আদালতে দেখানো হচ্ছে তাতে পারুল নামের কোনো রোগির স্লিপে একটানে পারুল কেটে পারভীন করা হয়েছে। আসলে পারভীনকে ভর্তিই করা হয়নি।
জবাবে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সত্যিই পারভীনকে ভর্তি করা হয়েছিল। তবে তদন্ত কমিটির উচিত হয়নি তাদের এখতিয়ারের বাইরে যেয়ে আজিমপুর মেটারনিটিতে তদন্ত করা। তাছাড়া মেটারনিটি কর্তৃপক্ষ জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে।
এসময় আদালত বলেন, আপনি বলতে চাচ্ছেন এরা সবাই নির্দোষ। তাই এদের ছেড়ে দিতে হবে। তাই না? এরপর আদালত আদেশ দেন। পরবর্তী শুনানির জন্য ২৭ নভেম্বর দিন ধার্য করেছেন।
Discussion about this post