ব্যারিস্টার গাজী ফরহাদ রেজা: সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের বার কাউন্সিলের আইনজীবী তালিকাভুক্তি পরীক্ষা নেওয়ার জন্য আন্দোলনের খবর কারো নজর এড়িয়ে যাওয়ার কথা না। সুপ্রীম কোর্টের ভিতরে কিছু শিক্ষানবিশ আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করেন। সারা জীবন শুনে আসলাম শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা ভয় পায়, পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন করে, আর এখন পরীক্ষার জন্য আন্দোলন! ব্যাপারটা অনেক দুঃখের এবং অমানবিক। এই সমস্যার দ্রুত সমাধান একান্ত কাম্য। এই লেখাতে বর্তমান আইন অঙ্গনের উপরেউল্লেখিত সমস্যা ও এর থেকে উত্তরের উপায় নিয়ে একজন আইনজীবী হিসেবে আমার নিজস্ব চিন্তা এবং বক্তব্যে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক কেন পরীক্ষার্থীরা লেখা পড়া ছেড়ে রাস্তায় থাকতে বাধ্য হচ্ছে? কেন তাদের ন্যায্য অধিকারের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে? এ দায় কার? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য যেকোন আইনজীবী, আইনের ছাত্র, আইন গবেষক জেনে থাকবেন যে বাংলাদেশে আইনজীবী হিসেবে পেশা চালানোর জন্য একজন ব্যক্তিকে এলএলবি পাশ করার পর দশ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কোনো আইনজীবির তত্ত্বাবধানে ‘Intimation’ জমা দিতে হয় এর পর ছয় মাসের অভিজ্ঞতা অর্জনের পর একজন শিক্ষানবিশ বার কাউন্সিলের পরীক্ষায় বসতে পারেন। বার কাউন্সিল প্রতিবছর এই পরীক্ষা নিবে এটাই উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে বার কাউন্সিল এমন হয়েছ যে দুই বছর পার হলেও পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে নাই! যার ফলে হাজার হাজার এলএলবি পাশ করা শিক্ষানবিশ আইনজীবী পরীক্ষা দিতে না পেরে হতাশ হয়ে যাচ্ছেন। পরিচিত অনেক আইনজীবী বড়ো ভাই, সিনিয়র, বার কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্য অনেকের সাথেই কথা বলে জানতে চেয়েছি যে কেন এমন সমস্যা দেখা দিচ্ছে এবং এর সমাধান কি? অনেকে অনেক কথাই বলেছেন, ব্যক্তিগত ভাবে তাদের মতামত দিয়েছেন কিন্তু একটি ব্যাপারে সবাই একমত যে দুই/তিন বছরেও একটা পরীক্ষা নেওয়া এটি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ব্যর্থতা এবং বার কাউন্সিলের উচিৎ হবে অতি দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করে শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। এই বিষয়ে আলোচনার মাঝে আমি এমন কিছু বিষয় বা মতামত খেয়াল করেছি যা নিয়ে আলোচনার অবকাশ রাখে।
প্রথমত, শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা কেন রাস্তায় আন্দোলন করবে, তাদের তো উচিৎ পড়াশুনা করা, সিনিয়রকে সহায়তা করা, পরীক্ষা যখন হবে হবে, এই সব আন্দোলন করে অহেতুক সময় নষ্ট করতেছে শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা। সত্যি কথা বলতে আমি আন্দোলনকারী কয়েকজনের সাথে আলোচনা করে যা জানতে পেরেছি তারা নিজেরাও এই আন্দোলন করতে চান না কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় তারা এই আন্দোলন করতে বাধ্য হচ্ছেন, যেন তাদের কণ্ঠ বার কাউন্সিলের দায়িত্ব প্রাপ্তদের কাছে পৌঁছানো যায়। আমিতো কোনো ভাবেই তাদের তাদের এই যুক্তির সাথে সহমত পোষণ না করে পারছিনা। কারণ আমরা আজ যারা প্র্যাক্টিস করছি তারা একদিন শিক্ষানবিশ ছিলাম এবং দেখেছি প্র্যাক্টিস করার সনদ থাকা আর না থাকার ভিতর অনেক পার্থক্য। এখন আইনের মেধাবী ছাত্র যখন দেখে যে অনার্স করার পর যেখানে তারই অন্য বিষয়ে পড়া বন্ধু ভালো জব পেয়ে যায়, জীবন শুরু করতে পারে তখনও সে সনদ পাওয়ার পরীক্ষায় বসতে পারে না! এইটা অনেক অমানবিক। আমাদের জীবন তো সংক্ষিপ্ত, কর্মজীবন আরো ছোট, তার উপর আইন পেশায় টিকে থাকা অনেক কঠিন একটা কাজ। তাই বছরে অন্তত একটা পরীক্ষা নিতে পারলেও সমস্যার অনেক সমাধান হবে বলে আমি মনে করি।
দ্বিতীয়ত, অনেক শিক্ষানবিশ মনে করেন বার কাউন্সিলের দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং সিনিয়র আইনজীবীরা আইনজীবীদের সংখ্যা কমানোর জন্য দেরি করে পরীক্ষার আয়োজন করেন। সাম্প্রতিক সময়ে আইনজীবীদের সংখ্যাধিক্য হয়েছে একথা সত্য। এর প্রভাব যে আইনপেশায় পড়েছে এটাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু তাই বলে এই কারণে বার কাউন্সিল পরীক্ষা নিচ্ছে না এই বিষয়ে আমি কোনো প্রমাণ পাইনি বা আমি নিজেও বিশ্বাস করি না। কারণ আইনজীবীদের এই সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য এলএলবি এর ভর্তির সময় থেকে ব্যবস্থা নিতে হবে, এলএলবি পাশ করার পর নয়। আমার জানা মতে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেশন এ ৫০ জনের বেশি ভর্তি করা যাবে না মর্মে বলেছে। বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রজ্ঞাপন না মেনে ছাত্র ভর্তি করে এবং ছাত্ররাও না জেনে ভর্তি হয়। যার ফলে সাম্প্রতিক সময়ে বার কাউন্সিল বিশেষ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন করতে দেয় নাই যার ফলে ব্যাপারটা কোর্ট পর্যন্ত গড়ায় এবং মনে করা হয় এটাও পরীক্ষা না হাওয়ার একটা কারণ। যা হোক সেই সমস্যার সমাধান হোয়েছে, সর্বোচ্চ আদালত থেকে সমাধান এসেছে আইন ভঙ্গকারী বিশ্ববিদ্যালয়কে জরিমানা করা হয়েছে এবং ভুক্তভুগী শিক্ষানবিশ দের কে পরীক্ষায় বসার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আইন ভঙ্গের কারণে উচ্চ আদালত ভুক্তভুগী শিক্ষানবিশদের পরীক্ষায় বসার অনুমতি নাও দিতে পারতেন কিন্তু মানবিক কারণে এমনটা হয়নি কারণ আইন পেশার সাথে যুক্ত সবাই জানেন আইনজীবী হিসেবে কাজ করার চ্যালেঞ্জটা। তো আমার মনে হয় ঢালাও ভাবে এইটা মনে করার কারণ নেই যে নতুনদেরকে পুরাতনরা চাননা বা তাদের পরীক্ষা পেছানোর এইটা কোনো কারণ বরং শিক্ষানবিশদের এই সমস্যা নিয়ে আমি দেখেছি বিভিন্ন ফোরামে সিনিয়র আইনজীবীরা আলোচনা করছেন কিভাবে কত দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করা যায়।
তৃতীয়ত, প্রশ্ন থেকে যায় আমরা কত দ্রুত এই সমস্যার সমাধান আশা করতে পারি? কারণ লোকমুখে শোনা ডিসেম্বরে পরীক্ষা হতে পারে, না হলে জানুয়ারী, না হলে একেবারে এপ্রিল মাসে কারণ এর মাঝে ঢাকা বার এবং সুপ্রীম কোর্ট বারের ইলেকশন আছে। তো এর মানে হলো, আমরা কেউ এখনো জানছি না যে কবে হবে পরীক্ষা। বার কাউন্সিলও এখনো কোনো কিছু জানায়নি। এভাবে চলা কি ঠিক? প্রতিবছর একটা নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষা হলে সবাই উপকৃত হয়। পরীক্ষার আয়োজকরা সঠিক এবং সুন্দর প্ল্যানিং করে পরীক্ষা নিতে পারে আর পরীক্ষার্থীরা তাদের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারে এতে পরীক্ষায় পাশ করার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে মনে করি পরীক্ষা কবে হবে, বা আদৌ হবে কিনা এই চিন্তা একজন পরীক্ষার্থীর জন্য অনেক ক্ষতিকর এবং এইটা আমরা যারা প্র্যাক্টিস করছি তাদের জন্যও বিব্রতকর কারণ আমরাও সারা দিন কোর্ট-কাচারীতে থাকার পরও জানি না কখন কি হবে। তো এই বিষয়ে আসলেই একটি নিশ্চয়তা দরকার।
পরিশেষে আমার মনে হয় বিষয়টি নিয়ে আমাদের সিনিয়র আইনজীবী এবং আইনজীবী নেতৃবৃন্দের একমত হওয়া দরকার এবং চিন্তা করা দরকার যে কিভাবে নিয়মিত বার কাউন্সিল আইনজীবী অন্তর্ভুক্তি পরীক্ষা নেওয়া যায় এবং এটাও চিন্তার ভিতরে রাখা উচিৎ যে প্রতি বছরে এই পরীক্ষার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া যায় কিনা। আইনজীবির সন্তান হিসেবে আমি আমার বাবার কাছে শুনেছি বার কাউন্সিল আগে বছরে দুইটি পরীক্ষা নিয়েছে এমন নজিরও আছে। সেই তুলনায় বর্তমানের এই অবস্থা খুবই দুঃখের এবং মেনে নেওয়া কষ্টকর। আমাদের আইন অঙ্গনের সার্বিক অবস্থার উন্নতির প্রয়োজনে মেধাবীদের এই পেশায় আসতে উৎসাহিত করতে হবে। এর জন্য নিয়মিত পরীক্ষার মাধ্যমে নতুন আইনজীবী অন্তর্ভুক্তির কোনো বিকল্প নেই। এইটা সত্য আইনজীবীদের সংখ্যাধিক্য নিয়ে ভাবার বিষয় আছে কিন্তু সেইটার জন্য সামগ্রিক পরিকল্পনা প্রয়োজন, আইন শিক্ষার মান উন্নয়ন প্রয়োজন, আইন পেশা এবং আইন শিক্ষার ভিতর একটি সমন্বয় প্রয়োজন। বার কাউন্সিল, সরকারি এবং বেসরকারি ইউনিভার্সিটি কতৃপক্ষের সাথে ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশনের সমন্বয় প্রয়োজন। পরীক্ষা না নেওয়া কোন সমস্যার সমাধান হতে পারে না। নিয়মিত পরীক্ষা নিতে হবে। না হলে বাংলাদেশের আইন পেশা অনেক মেধাবী আইনজীবী পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে। সঠিক সময়ে আইনজীবী তালিকাভূক্তি পরীক্ষা না হাওয়ার কারণে শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের জীবন থেকে অনেক মূল্যবান সময় হারিয়ে যাচ্ছে যা তারা আইন পেশায় নিয়োজিত করতে পারতেন। তাই বিষয়টি নিয়ে বার কাউন্সিলের দায়িত্ব প্রাপ্তদের এবং আমাদের বিজ্ঞ সিনিয়রদেরকে ভাবার জন্য অনুরোধ করছি। কারণ আমরা যারা আইনজীবী হিসেবে প্র্যাক্টিস করছি তারা কেউ এর দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না। আমাদের ভবিষ্যত আইনজীবীদের পথ চলা সুস্থ স্বাভাবিক এবং নিয়মতন্ত্রিক করাও আইনজীবী হিসেবে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।
Discussion about this post