একে.এম নাজিম, হাটহাজারী চট্টগ্রাম প্রতিনিধিঃ ধর্মনিরপেক্ষতার নামে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও আদর্শিকভাবে জাতিকে ধর্মহীনতার দিকে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগ এনে এর মোকাবেলায় জনসচেতনতা তৈরী ও করণীয় নির্ধারণের লক্ষে হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের এক জরুরী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং উলামা-মাশায়েখ ও ইমাম-খতীবগণের ধর্মীয় কাজে নিয়ন্ত্রণ আরোপের অভিযোগ এনে এ সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরী এবং বিভাগীয় ও জাতীয় পর্যায়ে উলামা-মাশায়েখ সম্মেলনের মাধ্যমে সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা হয়।
গতকাল (সোমবার) হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফীর সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মহাসচিব আল্লামা হাফেজ জুনায়েদ বাবুনগরী, মাওলানা সালাহ উদ্দীন নানুপুরী, মাওলানা সলিম উল্লাহ, মাওলানা লোকমান হাকিম, মাওলানা মোজাফফর, মাওলানা আনাস মাদানী, মাওলানা মুঈনুদ্দীন রুহি, মাওলানা আজিজুল হক মাদানী, মাওলানা মাহমুদুল হাসান, মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদি, মাওলানা ফোরকান আহমদ, মাওলানা আশরাফ আলী, মাওলানা মুনির আহমদ, মাওলানা আইয়ুব, মাওলানা ইসহাক, মাওলানা জাকারিয়া নোমান, মাওলানা লুৎফর রহমান, মাওলানা হাবীবুল্লাহ আজাদী, মাওলানা হাফেজ মোজাম্মেল, মাওলানা ফয়সাল, মাওলানা আব্দুল মতিন, মাওলানা শফিউল আলম প্রমুখ।
বৈঠকে হেফাজত আমীরের উপস্থিতিতে তাঁর পক্ষে ৪ পৃষ্ঠার লিখিত প্রস্তাবনা পাঠ করেন আমীরের প্রেস সচিব মাওলানা মুনির আহমদ। এরপর মহাসচিবসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ বর্তমান পরিস্থিতির উপর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিয়ে করণীয় নির্ধারণের জন্য প্রস্তাবনা আকারে স্ব স্ব অভিমত প্রকাশ করেন।
বৈঠকে হেফাজত আমীর বলেন, সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাসের ধারা বাতিল এবং ধর্মনিরপেক্ষ নীতি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভয়াবহ আকারে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামী আদর্শ ও সংস্কৃতির আঘাত হানা হচ্ছে। ৯২ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশের ইসলাম প্রিয় তৌহিদী জনতা ও আলেম সমাজ যেন নিজ ঘরেও পরবাসীর মতো হয়ে ওঠেছি। কারণ বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের মতো আমাদের দেশের ক্ষমতালিপ্সু মহল এবং সমাজের ভোগবাদি শ্রেণী তাদের পথে আলেম সমাজ ও তৌহিদী জনতাকেই প্রধান বাধা মনে করছেন। তাই দেশবাসীর অন্তর থেকে ইসলামী চেতনাবোধ বিলুপ্ত এবং আলেম সমাজ ও মাদ্রাসা শিক্ষাকে কোণঠাঁসা ও ধ্বংস করার জন্য কোন ধরণের রাখঢাক ছাড়াই আজ এসব প্রতিষ্ঠানকে টার্গেটে পরিণত করেছে। তিনি বলেন, একদিকে ভবিষ্যত প্রজন্ম যাতে ইসলাম ও আলেম-ওলামা বিদ্বেষী, ধর্মবিমুখ ও ভোগবাদি হয়ে গড়ে ওঠে, তার জন্য শিক্ষা, সংস্কৃতি ও আদর্শিকভাবে ইসলাম বিমুখ কইে তাদেরকে গড়ে তোলার আয়োজন চলছে, অন্যদিকে নানা মিথ্যাচার, অপবাদ, অপপ্রচার ও প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে আলেম সমাজের ঐক্য বিনষ্ট ও মাদ্রাসা শিক্ষাকে কোণঠাঁসা করার ষড়যন্ত্র চলানো হচ্ছে। তিনি বলেন, এতে স্বৈরাচারী শাসক মহলের উদ্দেশ্য হচ্ছে, জনসাধারণের মন-মগজে ভোগবাদি চেতনা উস্কে দিয়ে বৈধ-অবৈধ যে যেভাবে পারে অর্থ-কামাই ও আনন্দ-উল্লাসের দিকে সবাইকে ব্যতিব্যস্ত রাখা। উদ্দেশ্য, মানুষকে ভোগবাদি মানসিকতায় গড়ে তুলে সেই ভোগবাদিতার জন্য অর্থ কামাইয়ে ব্যস্ত রেখে অবৈধ শাসনকে পাকাপোক্ত করা। আর যারা ধর্মহীনতা ও নীতিহীনতার দিকে যাবে না, তাদেরকে নতুন নতুন সংকট ও ষড়যন্ত্রমূলক পরস্পর দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আত্মবিধ্বংসী কাজে জড়িয়ে কোণঠাঁসা করে রাখা। সুতরাং এহেন সংকটময় মুহূর্তে ইসলামের ধারক-বাহক সচেতন আলেম সমাজের চুপ থাকার সুযোগ নেই। সাধ্যমতো প্রতিবাদ-প্রতিরোধের পাশাপাশি আমাদেরকে কৌশলী ভূমিকা নিতে হবে।
আল্লামা শাহ আহমদ শফী আরো বলেন, নতুন প্রজন্মের প্রায় ৮০-৯০ ভাগ শিশু-কিশোর জেনারেল শিক্ষা তথা স্কুল-কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করে থাকে। যারা ভবিষ্যতে দেশ চালাবে, সমাজের অধিপতি হবে, মিল-ইন্ডাস্ট্রির মালিক হবে, বিভিন্ন ব্যবসা চালাবে, সরকারী বিভিন্ন দফতরে চাকুরী করবে, পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীতে যোগ দিবে। বলতে গেলে পুরো দেশের ৮০-৯০ ভাগ জনগণের অংশ। এই বিশাল অংশকে ধর্মহীন, ইসলামী চেতনাহীন এবং মাদ্রাসা ও আলেম-উলামা বিদ্বেষী করার পাশাপাশি ভোগবাদি মানসিকতা নিয়ে গড়ে ওঠার জন্য নতুন শিক্ষানীতি চালু করা হয়েছে। তিনি বলেন, দেশের স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকের ৫৭ থেকে ৮০ ভাগ বই অমুসলিমদের লেখা। এতে করে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি প্রকৃত মুসলমান থাকবে? অমুসলিমদের লেখা এই বিপুল সংখ্যক বইয়ের মাধ্যমে সুকৌশলে ১৫ কোটি মুসলমানের সন্তানদের আত্মপরিচয় ও ধর্মীয় ভাবধারা ভুলিয়ে দেয়া হচ্ছে। প্রাইমারি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত অমুসলিম শিক্ষকদের গড় হার ৫৮ ভাগেরও বেশি। কোনো কোনো বিদ্যালয়ের ৮৫ ভাগ শিক্ষকই অমুসলিম। একটি শিশু কোমল মন নিয়ে যখন শিক্ষালাভ শুরু করে তখন তার শিক্ষকের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি সে আসক্ত হয়ে পড়ে। স্বাস্থ্য শিক্ষার নামে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের যৌনতার সবক দেয়া হচ্ছে। এর ফলে প্রচলিত সহশিক্ষায় ছাত্র-ছাত্রীরা সহজেই বেহায়াপনা ও যৌনতায় জড়িয়ে পড়ছে। যার কুফল ইতিমধ্যেই আমরা অবলোকন করতে শুরু করেছি।
হেফাজত আমীর আরো বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে ইসলামহীনতার সকল আয়োজনের পাশাপাশি সরকারের মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে এনজিও এবং নাস্তিক-মুরতাদ চক্র বিভিন্ন সভা-সেমিনারে, টিলিভিশন ও পত্রপত্রিকায় ঢালাওভাবে আলেম-উলামাকে জঙ্গী ও সন্ত্রাসী বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে। ক্বওমী মাদ্রাসা শিক্ষাকে ভয়ংকর ও জাতির জন্য বোঝা বলে অপপ্রচারে নেমেছে। আলেম-ওলামা ও মাদ্রাসা শিক্ষিতদেরকে কথিত জঙ্গী, সন্ত্রাসী, নারী বিদ্বেষী ও গন্ডমূর্খ বলে প্রচার চালাচ্ছে। নাটক-সিনেমায় আলেম ও দাড়ি-টুপিধারীকে সন্ত্রাসী চরিত্রের অভিনয়ে দেখানো হচ্ছে। এতে করে সমাজে আলেম সমাজকে হেয় ও অবহেলিত করে একঘরে বা তাদের পরিধি সংকোচিত করার চক্রান্ত চালানো হচ্ছে।
হেফাজত আমীর আরো অভিযোগ করেন, দেশে কোন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটলেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে ও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রাণান্তরভাবে আলেমদেরকে জড়ানোর চেষ্টা আমরা দেখতে পাই এবং বিভিন্নভাবে আলেমদেরকে দেশ ও স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা এখন গোপন কিছু নয়। পাশাপাশি রাজনৈতিক সংকটকে ভিন্নদিকে মোড় দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে বার বার ক্বওমী মাদ্রাসার সাথে জঙ্গীবাদকে জড়িয়ে তৎপরতা চালানোও আমরা দেখে আসছি।
তিনি বলেন, অন্যদিকে গত কয়েক বছর থেকে বিভিন্ন ওয়াজ-মাহফিল ও তাফসীর মাহফিলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও অনুমতি নেওয়ার নিয়ম চালু করে উলামায়ে কেরামের দাওয়াতী তৎপরতায় কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আনতে সরকার সক্ষম হয়েছে। তিনি বলেন, এ ধরণের দূর্যোগময় পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয়, কর্মকৌশল কী হতে পারে, সে ব্যাপারে উপায় বের করার জন্যই আজকের বৈঠক।
বৈঠকে নিম্নোক্ত প্রস্তাব পাশ করা হয়। শিক্ষা, সংস্কৃতিতে ইসলামের উপর আঘাত এবং উলামা-মাশায়েখ ও ক্বওমী শিক্ষা বিরোধী তৎপরতা সম্পর্কে দেশব্যাপী উলামা-মাশায়েখ, মাদ্রাসা ছাত্র ও তৌহিদী জনতাকে অবহিতকরণের উদ্যোগ গ্রহণ। কেন্দ্রীয় টিমের তত্ত্বাবধানে অল্প সময়ের মধ্যে বিভাগীয় পর্যায়ে ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলনের আয়োজন। ক্বওমী মাদ্রাসাসমূহের ঐক্য আরো সুদৃঢ় করার জন্য বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ। আগমী ৪ মে চট্টগ্রাম পাবর্তী স্কুল মাঠে শানে রেসালাত ও শিয়া বিরোধী সম্মেলন আয়োজন।
Discussion about this post