নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের শিশু “অপহরন” এবং ধর্ষণ এর সংজ্ঞা স্ব-বিরোধী এবং ন্যায় বিচার পরিপন্থী যা যেকোন নিদোর্ষ ব্যাক্তির ন্যায় বিচার প্রাপ্তির পথকে সংকীর্ণ করেছে। প্রথমেই আসা যাক, সাক্ষ্য আইনের দিকে।
ধারাঃ ১১৮ “সকল ব্যক্তি সাক্ষ্য প্রদানের যোগ্য, যদি আদালত মনে না করেন যে, তাহার অল্প বয়স, দৈহিক অথবা মানসিক ব্যাধি অথবা অনুরূপ অন্যকোন কারনে তাহাদিগকে জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন বুঝিতে অথবা সেই যুক্তি সঙ্গত উত্তর দিতে তাহারা অক্ষম।”
অর্থাৎ যেকোন ব্যক্তি যদি আদালত মনে করেন যে, তিনি শারীরিক বা মানসিক অক্ষমতা ব্যতীত সকল প্রশ্ন বুঝিতে সক্ষম তবে তিনি সাক্ষ্য দিতে পারিবেন। এটাই সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী সাক্ষ্য প্রদানের ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির যোগ্যতার মাপকাঠি।
এবার আসা যাক নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে শিশু ধর্ষনের সংজ্ঞাঃ
ধারাঃ “৯” (১) যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষন করেন তাহালে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হবেন। “ব্যাখ্যাঃ যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ছাড়া ষোল বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলক ভাবে তার সম্মতি আদায় করে অথবা ষোল বছরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে সম্মতি সহ বা সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করেন তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষন করেছেন বলে গণ্য হবে।”
অর্থাৎ এই ধারা অনুযায়ী ষোল বছরের নীচের কোন নারীর সম্মতি সহকারে যৌন মেলামেশা করলেও তা ধর্ষন বলিয়া গন্য হইবে। এই সংজ্ঞা দ্বারা একজন অনুর্দ্ধ ১৬ বছরের নারীর মতামতকে আইনের দৃষ্টিতে অকার্যকর করা হয়েছে। কোন অনুর্দ্ধ ১৬ বছরের নারী যদি স্বেচ্ছায় কোন পুরুষের সাথে আবেগ বশতঃ যৌন মেলামেশা করে এবং পরবর্তীতে পারিবারিক বা সামাজিক চাপে উক্ত পুরুষের বিরুদ্ধে ধর্ষনের অভিযোগ আনয়ন করে তবে আদালত তা আমলে নিয়ে শাস্তি প্রদান করতে পারবে। এখন এই অনুর্দ্ধ ১৬ বছরের নারী যখন স্বেচ্ছায় যৌন মেলামেশা করার পর ধর্ষনের অভিযোগ আনেন তখন নারী ও শিশু আইনের ২২ ধারা অনুযায়ী তার জবানবন্দী গ্রহণ করা হয় এবং মেডিকেল পরীক্ষার সময়ও তার মতামত গ্রহণ করে আদালত তা আমলে নিয়ে একজন পুরুষকে দোষী সাব্যস্থ করে শাস্তি দিয়ে থাকেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, যার ইচ্ছা বা মাতমত যৌন মিলনের ক্ষেত্রে নারী ও শিশু আইনের ৯(১) অনুযায়ী “ওহাধষরফ” তাহলে তার জবানবন্দীর ভিত্তিতে (নারী ও শিশু আইনের ২২ ধারা, মেডিকেল পরীক্ষার ক্ষেত্রে ভিকটিম প্রদত্ত বর্ণনা) কোন ব্যক্তিকে সাজা প্রদান করা ন্যায় বিচার পরিপন্থী।
এখন আসা যাক নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধারা ২(খ) “অপহরণ” এর সংজ্ঞা- অর্থ বল প্রয়োগ বা প্রলুব্ধ করে বা ফুসলিয়ে বা ভূল বুঝিয়ে বা ভীতি প্রদশন করে কোন স্থান থেকে কোন ব্যাক্তিকে অন্যত্র যেতে বাধ্য করা।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৭ ধারায় একজন নারী ও শিশু অপহরণের শাস্তির বিষয়ে বর্ণনা দেয়া আছে।
অপহরণের সংজ্ঞানুযায়ী “অপহরণ” হতে গেলে তার অন্যতম উপাদন হল সংক্ষদ্ধ শিশুর মতামত, অর্থাৎ তার মতামতের বিরুদ্ধে তাকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া।
এখন বিষয় হলো একজন শিশু যার বয়স ১৬ বছরের নীচে তাকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী তার মতামতকে অকার্যকর করা হয়েছে। তাহলে সে মোতাবেক অপহরণের ক্ষেত্রে তার মতামত বা ইচ্ছার বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক, অযৌক্তিক। এক্ষেত্রে বিচারিক কার্যক্রমে দেখা যায় যে, একজন ১৪ বছরের নারী কোন পুরুষকে ভালবেসে তার সাথে চলে যায় কিন্তু পরবর্তীতে মেয়ের পরিবার ঐ পুরুষটির বিরুদ্ধে মামলা করলে এবং মেয়েটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারা অনুযায়ী ছেলেটির পক্ষে জবানবন্দী দিলেও তা আমলে নিতে চায়না কারন তার বয়স ১৬ বছরের নীচে। একজন নারী বা পুরুষের ইচ্ছা বা অনিচ্ছা এক ধরনের জবানবন্দী বা সাক্ষ্য হিসাবে গণ্য হয়। যদি ২২ ধারা মোতাবেক একজন অনুর্দ্ধ ১৬ নারী আসামীর পক্ষে জবানবন্দী প্রদান করলেও আদালত তার জবানবন্দী, আসামীর জামিন বা খালাসের বিষয়টি যদি বিবেচনা না করেন তাহলে কোন ব্যাক্তিকেই শিশু অপহরণের অপরাধে অভিযুক্ত করা যাবে না যতক্ষন না “অপহরণ” এর সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়।
তাই সময় এসেছে এই আধুনিক যুগে সময়ের সাথে “শিশুর” সংজ্ঞা তৎসংগে তার মতামত সাক্ষ্য আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ্য রেখে যুযোপযোগী করা উচিৎ নইলে একজন আসামী এই আইনের দ্বারা প্রকৃত ন্যায়বিচার হতে বঞ্চিত হবে।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।
Discussion about this post