শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় দায়ের করা সব মামলা সচল করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে কার্যতালিকায় আনতে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের পর গত ২৪ জানুয়ারি বিভিন্ন মামলায় নিয়োগ করা আইনজীবীকে চিঠি দিয়ে ও টেলিফোন করে মামলাগুলো সচল করতে নির্দেশ দিয়েছে সংস্থাটি।
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে ১৯৯৬ সালে। ওই ঘটনায় ১৩টি মামলা করে বিএসইসি, যার বেশিরভাগই এখন স্থগিত। এসব মামলায় প্রভাবশালী বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আসামি। ২০১০ সালের দ্বিতীয় কেলেঙ্কারির ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলাও স্থগিত রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে মামলাগুলোর ব্যাপারে কোনো খোঁজ নিচ্ছিল না বিএসইসি। গত ২৭ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে শেয়ার কেলেঙ্কারির মামলাগুলো দ্রুত সচল করাসহ হালনাগাদ তথ্য চাওয়া হয় বিএসইসির কাছে। তারপর থেকেই নড়েচড়ে বসেছে সংস্থাটি। ২৪ জানুয়ারি শেয়ার কেলেঙ্কারির ১৫টি মামলাসহ বিভিন্ন সময় পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট আইন ভঙ্গের দায়ে করা আরও ১০টি মামলার সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে বিএসইসি। বিএসইসির পক্ষে বেশিরভাগ মামলায় লড়ছেন আইনজীবী প্রবীর নিয়োগী। তিনি বলেন, স্থগিত থাকা মামলাগুলোর স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারসহ দ্রুত শুনানির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনায় ফার্স্ট ক্যাপিটাল সিকিউরিটিজ লিমিটেড ও রিজওয়ান বিন ফারুকের নামে দায়ের করা মামলাটি আসামি পক্ষের রিট পিটিশনের ফলে ২০০৬ সালের ১৫ জুন স্থগিত করেন হাইকোর্ট। পরে ওই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের আবেদন করে বাদীপক্ষ। ৬ ফেব্রুয়ারি বাদীপক্ষের আবেদনের ওপর শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। মামলাটির স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারসহ দ্রুত শুনানির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বিএসইসি তাদের নিয়োগ দেওয়া আইনজীবীকে গত ২৪ জানুয়ারি চিঠি পাঠিয়েছে।
একই কেলেঙ্কারির দায়ে দোহা সিকিউরিটিজ ও এ কে এম সামসুদ্দোহার নামে দায়ের করা মামলাটি ২০০৭ সালে খারিজ করেন হাইকোর্ট। ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে বিএসইসির পক্ষে আপিল করা হয়েছে, যা এখন বিচারাধীন। ৩ ফেব্রুয়ারি এ মামলার আপিল নিষ্পত্তি-সংক্রান্ত বাদীপক্ষের তদবির অবহিত করার দিন ধার্য ছিল। মামলাটি দ্রুত শুনানির জন্য কার্যতালিকায় অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়ে নিযুক্ত আইনজীবী আবদুল হাইকে গত ২৪ জানুয়ারি চিঠি দিয়েছে বিএসইসি।
এস ই এস কোম্পানি, রুনা আলম ও সাবেত সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটির কার্যক্রম চ্যালেঞ্জ করে আসামিপক্ষ ২০১৪ সালে আবেদন করলে নিম্ন আদালতের কার্যক্রমের ওপর ৬ সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দেন হাইকোর্ট। পরে রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত রাখে উচ্চ আদালত। এ মামলার নথি বর্তমানে হাইকোর্টে রয়েছে। বিএসইসি আইনজীবীকে গত ২৪ জানুয়ারি চিঠি দিয়ে মামলাটি দ্রুত কার্যতালিকায় অন্তর্ভুক্তি ও শুনানির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছে।
মেসার্স এইচএমএমএস ফাইন্যান্সিয়াল কনসালট্যান্সি অ্যান্ড সিকিউরিটিজ লিমিটেড, হেমায়েত উদ্দিন আহমেদ, মুসতাক আহমেদ সাদেক, সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ, শরিফ আতাউর রহমান ও আহমেদ ইকবাল হাসানের বিরুদ্ধে ১৯৯৬-এর শেয়ার কেলেঙ্কারির দুটি মামলা করে বিএসইসি। আসামিদের আবেদনে একটি মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত হওয়ার পর হাইকোর্টের আদেশে রুল ডিসচার্জ করা হয়। অপর মামলাটির ওপর এখনও হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ রয়েছে। ওই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের আবেদন করেছে বিএসইসি। ৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার-সংক্রান্ত বাদীপক্ষের আবেদনের ওপর শুনানির দিন ধার্য আছে।
সিকিউরিটিজ কনসালট্যান্টস লিমিটেড, এম জি আজম চৌধুরী, শহিদুল্লাহ, প্রফেসর মাহবুব আহমেদের নামে দায়ের করা মামলায় নিম্ন আদালত ১৯৯৯ সালের মার্চে চার্জ গঠনের আদেশ দেন। ওই আদেশের বিরুদ্ধে প্রফেসর মাহবুব আহমেদ ২০১২ সালে হাইকোর্টে ক্রিমিনাল রিভিশন দায়ের করলে ওই বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট বিচারিক আদালতের মামলার ওপর স্থগিতাদেশ দেন। এখন স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত আছে। এই মামলায় বিএসইসির পক্ষের আইনজীবী ড. এ কে এম আলীকে গত ২৪ জানুয়ারি চিঠি পাঠিয়ে সংস্থাটি বলেছে, মামলাটি কার্যতালিকায় অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা গ্রহণসহ স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে দ্রুত শুনানির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে।
প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজ লিমিটেড, এ রউফ চৌধুরী, মসিউর রহমান, সাঈদ এইচ (হোসেন) চৌধুরী ও অনু জায়াগিরদারের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় আসামি সাঈদ এইচ চৌধুরী ও অনু জায়গিরদার গত বছর এ মামলার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেন। পরে গত বছরের ২১ নভেম্বর আদালত মামলার কার্যক্রম গত ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত স্থগিত করেন। এ মামলার অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের কোনো স্থগিতাদেশ না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম চলছে। আগামী ১ মার্চ সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য আছে। যে দুই আসামির পক্ষে হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দিয়েছেন, তা প্রত্যাহারে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে আইনজীবীকে চিঠি দিয়েছে বিএসইসি।
শেয়ার কেলেঙ্কারির দায়ে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, মোহাম্মদ ভাই ও আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বিরুদ্ধে থাকা মামলাটির কার্যক্রম চ্যালেঞ্জ করে আসামি আজিজ মোহাম্মদ ভাই ২০০৩ সালে হাইকোর্টে ক্রিমিনাল রিভিশন দায়ের করলে ওই বছর উচ্চ আদালত মামলা পরিচালনায় বিচারিক আদালতের ওপর স্থগিতাদেশ দেন। স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল আগামী ১৩ মার্চ হাইকোর্টের দেওয়া স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার-সংক্রান্ত বাদীপক্ষের তদবির অবহিত করার জন্য দিন ধার্য করেছেন। বিএসইসির পক্ষে এই মামলা লড়তেন সিনিয়র আইনজীবী মাহমুদুল ইসলাম। ২০১৩ সালে তার পরিবর্তে সিনিয়র অ্যাডভোকেট প্রবীর নিয়োগীকে আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সংস্থাটি। স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে দ্রুত শুনানির ব্যবস্থা করতে গত ২৪ জানুয়ারি আইনজীবীকে চিঠি দিয়েছে বিএসইসি।
এপেক্স ফুডস লিমিটেড, জাফর আহমেদ ও জহুর আহমেদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাটি উভয়পক্ষের শুনানি শেষে মহানগর দায়রা আদালত ২০১৪ সালের ২১ এপ্রিল আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে রায় দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে ওই বছরের ২৯ এপ্রিল রিভিশন দায়ের করে বিএসইসি। ওই বছরের তিন সেপ্টেম্বর নিম্ন আদালতের দেওয়া অব্যাহতি আদেশের ওপর ছয় মাসের স্থগিতাদেশ দেন হাইকোর্ট। পরে রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ওই স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ানো হয়। স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে মামলার কার্যক্রম বর্তমানে স্থগিত রয়েছে। মামলাটি দ্রুত শুনানির জন্য ব্যবস্থা নিতে আইনজীবীকে ২৪ জানুয়ারি চিঠি দিয়েছে বিএসইসি।
ইমতিয়াজ হোসেন অ্যান্ড কোম্পানি এবং ইমতিয়াজ হোসেনকে আসামি করে বিএসইসির দায়ের করা মামলার আসামি ইমতিয়াজ হোসেন মৃত্যুবরণ করায় অপর আসামিকে মামলার দায় হতে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য আসামিপক্ষ আদালতে প্রার্থনা করেন। আদালত তা নামঞ্জুর করলে আসামিপক্ষ হাইকোর্টে যায়। হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের মামলার ওপর স্থগিতাদেশ দেন। স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে বাদীপক্ষ স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের আবেদন করেছে।
২০১০ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুটি মামলা দায়ের করে বিএসইসি। এর মধ্যে সৈয়দ সিরাজউদ্দৌলা, রাশেদা আক্তার মায়া ও মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান মোড়লের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় আসামিপক্ষ ক্রিমিনাল রিভিশন করলে হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দিয়ে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে পাঠান। ফলে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল ২০১৫ সালের ৫ নভেম্বর আদেশে রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মামলার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন। এই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারসহ দ্রুত শুনানির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নিজস্ব আইনজীবীকে গত ২৪ জানুয়ারি চিঠি দিয়েছে বিএসইসি।
২০১০ সালের ঘটনায় আবু সাদাত মো. সায়েম ও মো. আবদুল মোবিন মোল্লাকে আসামি করে আরেকটি মামলা করে বিএসইসি। এ মামলার আসামিরাও হাইকোর্টে ক্রিমিনাল রিভিশন দায়ে করেন। ২০১৪ সালের ১১ নভেম্বর এক রায়ে হাইকোর্ট মামলাটির কার্যক্রম ২০১৫ সালের ১১ মে পর্যন্ত স্থগিত করেন। পরে ওই স্থগিতাদেশ ২০১৭ সালের ৮ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ফলে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত আছে। এ মামলাটিরও স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারসহ দ্রুত শুনানির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইনজীবীকে চিঠি পাঠিয়েছে বিএসইসি।
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির দায়ে বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, শাইনপুকুর হোল্ডিংস লিমিটেড, আসিফ এফ রহমান ও এবি সিদ্দিকুর রহমানের বিরুদ্ধে একটি এবং বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, সালমান এফ রহমান, আসিফ এফ রহমান ও ডিএইচ খানের বিরুদ্ধে পৃথক আরেক মামলা গত বছরের ১৬ মার্চ খারিজের আদেশ দেন হাইকোর্ট। কিছুদিন আগে সেই মামলার রায়ের সার্টিফায়েড কপি বের হওয়ার পর বিএসইসি তাদের আইনজীবী প্রবীর নিয়োগীকে টেলিফোনে ক্রিমিনাল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল দায়ের করার নির্দেশনা দিয়েছে। প্রবীর নিয়োগী জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন পর ওই রায়ের সার্টিফায়েড কপি পাওয়া গেছে। গত সপ্তাহে হাইকোর্টের খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে ক্রিমিনাল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল ফাইল করেছি। এখনও শুনানির দিন ধার্য হয়নি।
শেখ আবদুল্লাহ/সমকাল
Discussion about this post