নিম্ন আদালতে মামলাজট বহু আগে থেকেই ব্যাপক। এ জন্য বিচারাধীন পুঁজিবাজার সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির স্বার্থে ২০১৪ সালে গঠিত হয় শেয়ারবাজার ট্রাইব্যুনাল। এ ট্রাইব্যুনাল এখন নিষ্ক্রিয়। কারণ ট্রাইব্যুনালে মামলা নেই বললেই চলে। ট্রাইব্যুনালের প্রথম বিচারক হুমায়ুন কবীর নিম্ন আদালতে ঝুলে থাকা মামলাগুলো দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরের জন্য শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে মৌখিক ও লিখিতভাবে বহুবার অনুরোধ জানিয়ে ছিলেন। তাতে কোনো লাভ হয়নি। মামলা না থাকার কারণে তিনি বদলি হয়ে গেছেন রংপুর জেলা আদালতে।
গত বছরের ১৪ জুলাই ট্রাইব্যুনালে আকবর আলী শেখ নামে নতুন বিচারক যোগ দেন। তিনিও মামলার অভাবে এক প্রকার অলস সময় কাটাচ্ছেন। গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে একদিনের জন্যও তাকে আদালতে উঠতে হয়নি। প্রায় তিন মাস পর গত ৮ জানুয়ারি মার্ক বাংলাদেশের বিচারাধীন মামলার শুনানির জন্য প্রথম আদালতে বসেছিলেন তিনি। পরের শুনানির জন্য এ আদালত বসবে আগামী ১৮ জানুয়ারি।
অথচ এখনও দেশের বিভিন্ন আদালতে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট বিচারাধীন মামলা ৫১৫টি। এরমধ্যে ২৮৯টিই নিম্ন আদালতে। মামলাগুলোর অধিকাংশ জরিমানা আদায়ে সার্টিফিকেট মামলা। রয়েছে শেয়ার কারসাজি ও পুঁজিবাজার সংক্রান্ত বেআইনি গুরুতর অপরাধের মামলাও।
ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানিয়েছে, ঢাকার নিম্ন আদালত থেকে এখই অন্তত ৩০টি মামলা ট্রাইব্যুনালে আনা সম্ভব। তবে কমিশন খুব বেশি তৎপর নয় বলে মামলা আসছে না। গত দুই বছর ধরে কমিশনের আইন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা মামলাগুলো দ্রুত স্থানান্তরের জন্য কাজ করছেন। এজন্য তিন আইনজীবীকে নিয়োগও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নানা অজুহাতে ট্রাইব্যুনালে মামলা স্থানান্তর হচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) আইনজীবী মাসুদ রানা খান বলেন, মামলাগুলো পুরনো হওয়ায় তার রেকর্ড খুঁজে পেতে সময় লাগছে। ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে চলমান দুই মামলার একটি (মার্ক বাংলাদেশ) ৫-৬ মাসের চেষ্টায় নথি বের করে গত অক্টোবরে ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়েছে। এর আগের ছয় মাস ট্রাইব্যুনালে সক্রিয় মামলা ছিল না।
তবে ট্রাইব্যুনাল গঠনের সময়ই নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, দ্রুততার সঙ্গেই নিম্ন আদালতে বিচারাধীন সব মামলা ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরিত হবে। যা এখনও হয়নি। নিম্ন আদালতে বিচারাধীন মামলা হাইকোর্টে গিয়ে স্থগিতাদেশ নিয়েছেন অনেক আসামি। ওইসব স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারেও শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি সক্রিয় নয়। এ অবস্থায় শেয়ারবাজার ট্রাইব্যুনাল অর্থহীন হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র জানায়, ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলেও এ সংক্রান্ত আইনে সরাসরি ট্রাইব্যুনালে মামলা করার বিধান রাখা হয়নি। এ কারণে শাহজিবাজার পাওয়ার কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজির দায়ে একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েও তা প্রত্যাহার করেছে বিএসইসি। পরে জরিমানা করে ওই কারসাজির ঘটনার ইতি টানা হয়। জানতে চাইলে বিএসইসির কমিশনার সালাম সিকদার বলেন, ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করে সরাসরি মামলা দায়েরের বিধান যুক্ত করার প্রস্তাবের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি।
সূত্র জানায়, নতুন করে গতি ফেরায় শেয়ারবাজারে বহু কারসাজির ঘটনার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। আইপিও প্রক্রিয়ায় মূলধন উত্তোলনের অর্থ বেহাত হওয়ার অভিযোগ আসছে অনেক। এগুলোর বিষয়ে তদন্ত করতে তেমন আগ্রহী নয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বিএসইসির সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তাদের যুক্তি, কারসাজির তদন্ত বাড়লে এবং মামলা হলে বিনিয়োগকারীদের মনে আবার আতঙ্ক সৃষ্টি হতে পারে। তাতে থমকে যেতে পারে বাজারের নতুন করে ফিরে আসা গতি।
এদিকে ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানিয়েছে, কমিশন নিষ্ক্রিয় হলেও এ ট্রাইব্যুনাল তার সক্রিয়তার প্রমাণ দিয়েছে। ২০১৫ সালের জুনে বিচারিক কার্যক্রম শুরুর পর নিম্ন আদালতের ২৪টি মামলা ট্রাইব্যুনালে এসেছে। এর ১০ মাসের মধ্যে ছয়টির বিচার হয়েছে। বর্তমানে দুটি বিচারাধীন এবং বাকি ১৬টি মামলা পরিচালনার ওপর আগে থেকেই উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ রয়েছে
বর্তমানে বিচারাধীন দুই মামলার মধ্যে ১৯৯৬ সালে তালিকাভুক্ত হওয়া মার্ক বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির আইপিওর অর্থ বেহাত হওয়া সংক্রান্ত মামলাটি চলমান আছে। এ ছাড়া কয়েকদিন আগে এসপিএমএল নামক ব্রোকারেজ হাউসের শেয়ার কারসাজির মামলায় ট্রাইব্যুনাল নিজে থেকে সক্রিয় করার উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রসঙ্গত ২০১৪ সালের ৭ জানুয়ারি আইন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে শেয়ারবাজার সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। একই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারিতে ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে ময়মনসিংহের জেলা জজ হুমায়ুন কবিরকে নিয়োগ দেয় সরকার। ১৫ মার্চ তিনি যোগ দেন। ট্রাইব্যুনালের এজলাসসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ শেষে ২০১৫ সালের ২১ জুন বিচারকার্য শুরু হয়।
ট্রাইব্যুনালের নিষ্ক্রিয়তার বিষয়ে জানতে চাইলে কমিশনার সালাম সিকদার দাবি করেন, ট্রাইব্যুনাল কাজ করছে। তবে মামলা ও বিচার বেশি হলে শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হয়। তিনি সমকালকে বলেন, তারপরও ট্রাইব্যুনালকে আরও সক্রিয় করতে সরাসরি ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করাসহ অন্তত সাতটি ধারা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধন চেয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হবে। এ প্রস্তাবে ট্রাইব্যুনালের মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির বিধানেরও প্রস্তাব রয়েছে বলে জানান তিনি।
বিপুল সংখ্যক সার্টিফিকেট মামলা দশকের পর দশক নিষ্পত্তি না হওয়ার বিষয়ে কমিশনার বলেন, ট্রাইব্যুনালকে এ সকল মামলা নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া যায় কি-না, তা বিবেচনা করে দেখা হচ্ছে। এজন্য আইন সংশোধন করতে হবে। তবে সমস্যা হলো সার্টিফিকেট মামলা পরিচালনা করেন সিনিয়র সহকারী সচিব মর্যাদার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। ট্রাইব্যুনালের বিচারক জেলা জজ বা সচিব মর্যাদার। ফলে নিচের কর্মকর্তার কাজ ট্রাইব্যুনাল করতে চাইবে কি-না, তা দেখার বিষয়। শেষ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালকে দেওয়া না গেলেও কমিশন কোনো কর্মকর্তাকে এ জন্য নিযুক্ত করতে পারে কি-না, তাও খতিয়ে দেখা হবে।
সার্টিফিকেট মামলা হলো আইন লঙ্ঘনের দায়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে করা জরিমানার অর্থ আদায়ে করা মামলা। দায়ী ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জরিমানার অর্থ পরিশোধ না করলে কমিশন এ মামলা করে থাকে।
শেয়ারবাজারের শৃঙ্খলার স্বার্থে ট্রাইব্যুনালকে সক্রিয় করা অত্যাবশ্যক বলে মনে করেন বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনাল গঠন হয়েছে শেয়ারবাজার সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য। এখন ট্রাইব্যুনালই মামলার অভাবে নিষ্ক্রিয় থাকা দুঃখজনক। মামলা হলে বা সাজা হলে শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে- এমন ধারণা নিয়ে বসে থাকলে কোনোদিনই শেয়ারবাজারের কারসাজি বন্ধ হবে না। আনোয়ার ইব্রাহীম/সমকাল
Discussion about this post