প্রচলিত শ্রম আইন ও বিধিমালা পরস্পর সাংঘর্ষিক। শ্রমিকের স্বার্থরক্ষায় বিধিমালার সংশোধন প্রয়োজন। অধিকার প্রতিষ্ঠায় শ্রমিককে মালিকানার অংশীদার করতে হবে। নজর দিতে হবে প্রতিষ্ঠানের কাঠামো, বিদ্যুৎ ও অগ্নি নির্বাপণের উপযুক্ত ব্যবস্থার দিকে।
‘রানা প্লাজা ট্রাজেডি’ পরবর্তী পরিস্থিতিতে দেখা গেছে- ক্ষতিগ্রস্তরা তিনবছরেও ক্ষতিপূরণ পায়নি। আইনি প্রক্রিয়ায় প্রাথমিক কোনো নিষ্পত্তিও আসেনি। এতোবড় ঘটনার পরেও ৯শটি প্রতিষ্ঠান এখনো পরিদর্শনের বাইরে। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের ভূমিকাও বিতর্কিত হয়েছে।
এসব বিষয় উঠে এসেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত আলোচনায়।
শনিবার (২৩ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টারে সংগঠনটি এ সংলাপের আয়োজন করে। ‘রানা প্লাজা ট্রাজেডি’ পরবর্তী তিন বছরে এ নিয়ে পঞ্চমবারের মতো প্রতিবেদন দিলো সিপিডি।
এবারের বিষয় ছিলো ‘অন রি-ইমার্জিং ফ্রম দ্যা রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি- অ্যান অ্যাকাউন্ট অন দ্যা থার্ড অ্যানিভার্সারি’।
এদিনের আয়োজনে সিপিডি চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান, ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান, অ্যাডিশনাল রিসার্চ ডিরেক্টর ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, ব্যারিস্টার সারাহ হোসেন ছাড়াও অংশ নেন ইউএস, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, স্পেন, সুইডেন, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত, হেড অব ইউএন ওম্যান, ডেনমার্ক, আইএলও, অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স, বিজিএমইএ প্রতিনিধি ও শ্রমিক নেতারা।
রেহমান সোবহান বলেন, শ্রমিকশ্রেণীকে মালিকানার সহযোগী বা অংশীদার করা প্রয়োজন, বাড়াতে হবে প্রতিষ্ঠানের পরিবীক্ষণ কাঠামোতে নজরদারি। তাছাড়া পাঁচ ডলারের সামগ্রী বাইরে গিয়ে ২৫ ডলারে বিক্রির মাঝখানে কারা কাজ করছেন, সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। মাঝের এ ২০ ডলারের হিসেবটি সমন্বয় করতে হবে।
সিপিডি চেয়ারম্যান বলেন, রানা প্লাজা ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা তিনটি বছর পেরিয়েও ক্ষতিপূরণ পাননি। এ ক্ষতির কোনো পূরণও হয় না। তাদের কষ্ট আজও কমেনি। এখানেই শেষ যেন না হয় বিষয়টি।
দেবপ্রিয় পুরো অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, সবার নিজের অবস্থান তুলে ধরার সুযোগ করে দিতে সিপিডি সংলাপ একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে।
রেহমান সোবহান বলেন, শুধু সরকার, বা প্রশাসন, বা কারখানা মালিক- কেউই একা সব ব্যবস্থা নিতে পারে না। সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সরকার, সিভিল সোসাইটি, স্টেকহোল্ডার, শ্রমজীবী, বায়ার- কেউ এ গণ্ডির বাইরে থাকার সুযোগ নেই।
তিন বছরের হালনাগাদ তথ্যের প্রতিবেদন পাঠ করেন গোলাম মোয়াজ্জেম। এতে বলা হয়, ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষতিপূরণ পায়নি। স্বলব্ধ উপলব্ধি হলো- প্রতিষ্ঠান নয়, ঘটনার পর তাৎক্ষণিকভাবে ব্যক্তি বা বিচ্ছিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে। ব্যাখ্যামূলক উদ্যোগ হিসেবে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছ থেকে এসেছে। দুর্ঘটনার পর তিন হাজার ৬শ ৩২ কারখানা পরিদর্শন হলেও বাকি রয়েছে ৯শটি কারখানা। ভবন সংস্কারের আড়াই কোটি টাকা এখনো আসেনি।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট বলেন, বাংলাদেশে অনেক ভালো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু একটি খারাপ ঘটনা ভালো ঘটনাগুলোকে ঢেকে দেয়। এদেশের সস্তা শ্রমের কারণে নয়, এদেশের পণ্যের মান ও শ্রমিকদের কর্মনৈপূণ্যের কারণেই বাইরে এ দেশি পণ্যের কদর। পোশাক শিল্পসহ দেশের অগ্রগতির বিষয়গুলোতে আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে আছি।
অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের ভূমিকার প্রশংসা করেন সুইডিশ রাষ্ট্রদূত জোহান ফ্রিসেল ও স্পেন রাষ্ট্রদূত এডোয়াডো ডি লেইগ্লেসিয়া ওয়াই ডেল রোসাল। তাদের মতে, শ্রমিকের নিরাপত্তার কথা ভেবেই অ্যাকর্ড-অ্যালয়েন্স এসব করছে।
কিন্তু উল্টো বক্তব্য সংসদ সদস্য ইস্রাফিল আলমের, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী ভূমিকা দেখিয়েছে। তাদের কাজ মনিটরিং প্রয়োজন। ব্যবসায়ীদের চাপে পড়ে তাদের কাজের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন তারা নিজেদের পছন্দের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে।
অ্যাকর্ড প্রতিনিধি বলেন, আমাদের প্রতিবেদন স্বচ্ছ, এতে মনগড়া কিছু নেই।
আইনি প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে সারাহ হোসেন বলেন, ক্ষতিপূরণ অধিকার, নাকি ক্ষতির পূরণ- সেটি নিয়ে আইনি আলোচনা চলছে। এছাড়া এমন ঘটনায় দায়ী কারা- মালিক, নাকি স্থানীয় প্রশাসন, নাকি ব্র্যান্ডগুলো- সেটিও আলোচনায় আসছে।
ড. হামিদা হোসেন বলেন, দুর্নীতি, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, নজরদারির দুর্বলতায় এমনটি হচ্ছে। কোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে ছয়দিনের মধ্যে আলোচনার কথা বলে তিনবছরেও তা হয়নি।
শ্রমিক লীগের সভাপতি শুক্কুর মাহমুদ ও বিজিআইডব্লিউএফ সভাপতি বাবুল আখতার বলেন, কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি ক্ষতিগ্রস্তরা। তারা যা পেয়েছে সেগুলো দান, অনুদান, ডোনেশন।
বিসিডব্লিউএস প্রতিনিধি কল্পনা আখতার বলেন, কারখানা পরিদর্শনে এলে মালিকরা পরিদর্শকদের প্রভাবিত করেন। এভাবে প্রতিবেদনটিও আসে প্রভাবিত হয়ে। তাই সত্যিকার অর্থে সুফল পাওয়া যাবে কতদূর- সেটি দেখতে হবে।
শ্রমিক ও মালিক- কারও স্বার্থই যেন বিঘ্নিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখার বিষয়টিতে জোর দেন সব আলোচক। এতে ট্রেড ইউনিয়নের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও আলোচনা হয়।
Discussion about this post