আশরাফুল আলম খোকন
ষোড়শ সংশোধনীর বাতিলের রায় নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন মনের মধ্যে জাগ্রত হয়েছে। মারাত্মক আপত্তি করার বিষয়ও এখানে আছে। দীর্ঘদিন ঘাপটি মেরে থাকা বিএনপি জামাত ও তাদের সমর্থক সুশীল রা এই রায়ের পর গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন। আমি বলছি না মাননীয় প্রধান বিচারপতি বিএনপি জামাত কে সেই সুযোগ টা করে দিয়েছেন। রায়ের পর থেকেই জামাত-বিএনপি নেতারা এই রায়ের পক্ষে একেরপরএক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে তাদের আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটেছে।
এই রায় নিয়ে সরকার সমর্থকরা অনেকদিন চুপই ছিলেন। জামাত-বিএনপি’র বিরতিহীন প্রতিক্রিয়ার পর যখন আওয়ামীলীগের নেতা কর্মীরা কথা বলা শুরু করলেন, তখনই আবার প্রধান বিচারপতির আবির্ভাব। তিনি বললেন, এই রায় নিয়ে রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এখনো সবাই বলেই যাচ্ছেন। তাতে মনে হয়েছে রাজনীতির যথেষ্ট সুযোগ এইখানে আছে। আমার মনেও কিছু প্রশ্ন জেগেছে। ঐগুলোই তুলে ধরলাম ……
সংবিধানের ৬৫(১) ধারা অনুযায়ী আইন প্রণয়নের ক্ষমতা শুধুমাত্র আইন পরিষদ বা সংসদ এর হাতে। সুতরাং ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলকে বিচারপতি অভিশংসনের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে বলে যে প্রচার হচ্ছে তা ভুল। সাবেক দুইজন প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী এবং এবিএম খাইরুল হক ইতিমধ্যে বলেছেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হলে আপনা আপনি সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবিত হয়না। এই সংসদেই নতুন করে আইন প্রণয়ন করতে হবে।
যে সংসদকে অপরিপক্ক বলা হয়েছে। ওনার এই অপরিপক্ক সংসদেই বিচারপতিদের বেতনভাতা বাড়ানোর বিল পাস করেছে। অপরিপক্ক সংসদের নির্ধারণ করা বেতন দিয়েই তারা চলেন। এই সংসদ দ্বারা নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিই বিচারপতিদের নিয়োগ দেন। সংসদ অপরিপক্ক হলে ওনাদের নিয়োগও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ইঙ্গিত করেও তিনি বক্তব্য দিয়েছেন। যা সংবিধানের সাথেই সাংঘর্ষিক। সংবিধানের পঞ্চম তফসিলেই লেখা আছে মোহাম্মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের গুরুত্বের কথা, ষষ্ঠ তফসিলে ৭১ এর ২৬ মার্চে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা স্পষ্টই উল্লেখ করা যাচ্ছে। পাক শাসক ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর জন্যই ফাঁসির কাষ্ঠ প্রস্তুত করেছিলেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য ২৪ বছর কারা নির্যাতন বঙ্গবন্ধুই ভোগ করেছিলেন। এইসব নিয়ে লিখতে গেলে কয়েকটি নিবন্ধেও শেষ হবে না। শুধু এই টুকু বলি , জামাত বিএনপি এবং কিছু চৈনিক বাম যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিলেন , তাদের কথাগুলোই প্রধান বিচারপতি বলেছেন।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল করতে গিয়ে তিনি ৯৬ অনুচ্ছেদের ২,৩,৪,৫,৬,৭ উপধারা পুনস্থাপিত করেছেন, কিন্তু উপধারা ৮ পুনস্থাপন করেননি। অর্থাৎ ৮ অনুযায়ী বিচারপতিদের পদত্যাগ এর কোন সুযোগ নেই। এটা সাংবিধানিক শূণ্যতা।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কখনোই মূল সংবিধানের অংশ ছিল না, পরে সংযোজন করা হয়েছে, যা পরে সংযোজিত হয় তা বিয়োজনও করা যায়। অর্থাৎ এটা মুল কাঠামোর অংশ নয়।
বিচার বিভাগে এখনো জেনারেল জিয়ার জারি করা সামরিক ফরমান সংবিধানের অংশ রয়ে গেছে। সুপ্রিম কোর্টই জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। তাহলে তার প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল বৈধ হয় কিভাবে? পাকিস্তানেই সুপ্রিম জুডিশিয়াল আছে। ওদের আদলেই করা হয়েছিল। বিচারপতি জঙ্গি লিফলেটও বিতরণ করেছেন, জাল সার্টিফিকেটধারী বিচারপতি হয়েছেন এর কথাও আছে। কিন্তু এই পর্যন্ত কয়জন বিচারপতির বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা নিয়েছেন ?
সরকারের তিনটি বিভাগ নির্বাহী, বিচার ও আইন বিভাগ। সবারই দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। বিচারপতিদের যদি অভিশংসন আইন না হয় তাহলে বিচার বিভাগ দায়বদ্ধতার বাইরে থেকে গেলো। অর্থাৎ কোনো বিচারপতি অনৈতিক বা রাষ্ট্র বিরোধী কোনো কাজ করলে কিংবা অপ্রকৃতস্থ হলে সংবিধান মতে অভিশংসনের কোনো সুযোগ রইলো না। কেউই আইনের উর্ধ্বে হতে পারে না ।
সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্যদের অপমান করা হয়েছে। বলা হয়েছে যেহেতু তারা জনগণ দ্বারা সরাসরি নির্বাচিত নন, তাই তাদের বিচারপতিদের অভিসংশনে অংশ নেওয়াটা গণতন্ত্রবিরোধী। তাহলে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির অভিশংসনে সংরক্ষিত নারী সাসংদদের অংশ নেওয়া কী গণতন্ত্রের পক্ষে? ওই ধারাতো তারা বাতিল করেননি।
সরকারের সবগুলো বিভাগ সম্পর্কে আপত্তিকর ও বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করে প্রধান বিচারপতি আসলে কি চাচ্ছেন? ওনার এইসব বক্তব্যে জনমনে শঙ্কা তৈরী হওয়া স্বাভাবিক। আমাদের মনে রাখা উচিত ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এই দেশ। শান্তি কমিটির কিছু রাজাকার, আল বদর, আল শামস ছাড়া সবাই দেশটির পক্ষে ছিল। এই দেশটিকে নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র জাতি মেনে নিবে না।
লেখক: প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব
Discussion about this post