সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর থেকেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি এই রায়ের বিষয়ে বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে। আওয়ামী লীগের মতে, আগামী নির্বাচনের আগে এই রায়ের কিছু বিষয় সুযোগসন্ধানীদের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। অন্যদিকে বিএনপি এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছে। দুই দলের পাল্টাপাল্টি এই অবস্থানের মধ্যে ইতোমধ্যে রায় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে সরকারি দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ৭৯৯ পৃষ্ঠার এই রায়ে উল্লিখিত কিছু বিষয় যাতে বাদ দেওয়া হয় সে জন্য উদ্যোগ নেবে সরকার।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ওই নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে সরকারের কাছে যেসব বিষয় ‘আপত্তিকর’ বলে মনে হয়েছে, সেই বিষয়গুলো চিহ্নিত করা হয়েছে এরই মধ্যে। আইনমন্ত্রী তার সংবাদ সম্মেলনে বিষয়গুলো উপস্থাপন করবেন। এরপর ওই সব বিষয় যাতে ষোড়শ সংশোধনীর রায় থেকে এক্সপাঞ্জ করা হয় সে জন্য আপিল বিভাগে রিভিউ করবে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এ ছাড়া রায়ের আপত্তিকর অংশগুলো যাতে বাদ দেওয়া হয় সে লক্ষ্যে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখবেন সরকারি দলের নেতারা।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর আপিল বিভাগের দীর্ঘ রায়ে অনেক অপ্রাসঙ্গিক বিষয় উঠে এসেছে। জাতীয় সংসদ, নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী ব্যবস্থা, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রভৃতি নানা বিষয় রায়ের পর্যবেক্ষণে এসেছে। কিন্তু আমাদের দেখতে হবে, বিচার্য বিষয় কী ছিল? সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ১৯৭২-এর মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার বিষয়টিই ছিল মূল বিষয়বস্তু। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে সংসদের হাতে বিচারকদের অপসারণে ক্ষমতা পুনঃস্থাপন ছিল আলোচ্য বিষয়। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর দেখা গেল, এখানে সরকার, রাজনৈতিক দলের ভূমিকা, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ নানা বিষয় যোগ করা হয়েছে। এগুলো প্রাসঙ্গিক নয়। আমি যতটুকু জানি, রায়ের অপ্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো রিভিউ করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আবেদন জানানো হবে, যাতে রায় থেকে এগুলো এক্সপাঞ্জ করা হয়।
বর্তমান মন্ত্রিসভার এক জ্যেষ্ঠ সদস্যের মতে, ষোড়শ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায়কে অনেকেই বাহবা দিচ্ছেন, কারণ এখানে বর্তমান সরকার, রাজনৈতিক দল এবং বেশ কিছু বিষয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। তবে একটা বিষয় নিয়ে কেউ কেন প্রশ্ন তুলছেন না, ধান ভানতে যদি শিবের গীত গাইলেনই তারা তা হলে কেন ১৯৭৫-এর প্রসঙ্গ টানলেন না? কেন ১৯৭৫-এর হত্যাকাণ্ডের পর খুনিদের বিচার বন্ধে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের বিষয়ে কোনো প্রসঙ্গ আসল না রায়ে। এর অর্থ কী?
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র জানিয়েছে, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ক্ষমতাসীন দলের তিনজন আইনজীবী নেতা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেছেন। এর মধ্যে দুজন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সরাসরি সম্পৃক্ত, অপরজন ইতিপূর্বে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনমন্ত্রী ছিলেন। বর্তমান আইনমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধান বিচারপতির কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বিরোধ রয়েছে বলে সরকারের উচ্চপর্যায়ে যে তথ্য রয়েছে, সেই বিরোধ অবসানের জন্য দুপক্ষের সঙ্গেই আলোচনা করেছেন ওই ৩ নেতা।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য আবদুল মতিন খসরু গণমাধ্যমকে বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। আইনমন্ত্রী আগামী বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করবেন বলে জেনেছি। এ বিষয়ে যা বলার তিনিই বলবেন।
আওয়ামী লীগের নেতারা আরও জানিয়েছেন, ষোড়শ সংশোধনীর মূল বিষয় ছিল ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনা। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের সময় বিষয়টি এমনই ছিল। কিন্তু এরপর ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে তা পরিবর্তন করে অপসারণের ক্ষমতা অর্পিত হয় রাষ্ট্রপতির হাতে। পরে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আবার পরিবর্তন করে অপসারণ ক্ষমতা দেওয়া হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে। এর দীর্ঘদিন পর ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা আবারও সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। ষোড়শ সংশোধনীর ৯৬(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে, প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ছাড়া কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাবে না। এ ছাড়া ৯৬(৩) এ বলা হয়, দফা (২)-এর অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
দলটির নেতারা বলেন, ষোড়শ সংশোধনী পাস হওয়া মানে এটা ছিল না যে, সংসদ সদস্যরা চাইলেই একজন বিচারপতিকে অপসারণ করতে পারবেন। ওখানে আরও কিছু আইন প্রয়োজন ছিল বিচারপতি অপসারণের ক্ষেত্রে। যেমন বিচারপতিকে কোন প্রক্রিয়ায় তদন্ত করা হবে, তদন্ত কীভাবে প্রমাণিত হবে, তদন্তে একজন বিচারপতি অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার পরও যদি দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্য তার শাস্তির পক্ষে রায় না দেন সে ক্ষেত্রে কী হবে? এই বিষয়গুলো অমীমাংসিত ছিল। কিন্তু দেখা গেল, কিছু আইনজীবী এটা নিয়ে রিট করে আজকের এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেন। উচ্চ আদালতের সঙ্গে জাতীয় সংসদকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলেন। এটার তো কোনো প্রয়োজন ছিল না। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দুটি স্তম্ভ বিচার বিভাগ ও সংসদ বিভাগকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে কারা ফায়দা লুটতে চাচ্ছে এই বিষয়গুলোও এখন চিহ্নিত করার সময় এসেছে।
-আমাদের সময়
Discussion about this post