সিরাজ প্রামাণিক
মোবাইল কোর্ট আইনে আদালত পরিচালনা পরিচালনা নিয়ে আবেগ-উত্তাপ ও যৌক্তিক তর্ক-বিতর্ক এখনো চলছে, চায়ের দোকান থেকে পত্রিকার কলাম, টেলিভিশন টক শ’ পর্যন্ত। সন্দেহ নেই আরো কিছুকাল চলবে। চলাটাই স্বাভাবিক। সম্প্রতি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ সংশ্লিষ্ট আইনের কয়েকটি বিধান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।
মামলা সূত্রে জানা যায়, ভবন নির্মাণ আইনের কয়েকটি ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০১১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ‘এসথেটিক প্রপার্টিজ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড’ নামের প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান খানকে ভ্রাম্যমাণ আদালত ৩০ দিনের বিনাশ্রম কারাদ- দেন। সে বছরের ২০ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পান তিনি। এরপর ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের (মোবাইল কোর্ট অ্যাক্ট-২০০৯) কয়েকটি ধারা ও উপধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ১১ অক্টোবর কামারুজ্জামান হাইকোর্টে রিট করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর হাইকোর্ট রুল দেন। রুলে রিট আবেদনকারীর (কামরুজ্জামান) সাজা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়। পাশাপাশি সাজার আদেশ স্থগিত করা হয়।
আরেকটি সূত্রে জানা যায়, ভবন নির্মাণ আইনের কয়েকটি ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০১১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর টয়নবি সার্কুলার রোডে অবস্থিত এক বাড়ির মালিক মো. মজিবুর রহমানকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ৩০ দিনের বিনাশ্রম কারাদ- দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। আইনের বিধান ও অর্থ ফেরতের নির্দেশনা চেয়ে ওই বছরের ১১ ডিসেম্বর রিট করেন মজিবুর। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই দিন হাইকোর্ট রুলসহ সাজার আদেশ স্থগিত করেন।
এ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের কয়েকটি বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১২ সালে ২ মে দিনাজপুরের বেকারি মালিকদের পক্ষে মো. সাইফুল্লাহসহ ১৭ জন আরেকটি রিট করেন। এতে বেকারিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষেত্রে খাদ্য বিশেষজ্ঞ ও পরীক্ষার জন্য যন্ত্রপাতি সঙ্গে রেখে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা চাওয়া হয়। শুনানি নিয়ে ওই বছরের ৮ মে হাইকোর্ট রুলসহ অন্তবর্তীকালীন আদেশ দেন।
ন্যায়বিচার এমন একটি শব্দ, যার সাথে কিছু বিষয় এত নিবিড় ও গভীরভাবে জড়িত যে, এর যেকোন একটির কোন রকম ব্যত্যয় ঘটলে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। মার্কিন মানবতাবাদী মার্টিন লুথার কিং বলেছেন, ‘যে কোন জায়গায় অবিচার ঘটলে তা সমস্ত জায়গার বিচারকে হুমকির মুখে ফেলে। ফরাসী দার্শনিক আঁনাতোলে ফ্রান্স বলেছেন, ‘আইন যদি সঠিক হয় তাহলে মানুষও ঠিক হয়ে যায় কিংবা ঠিকভাবে চলে। আমাদের বিচার ব্যবস্থায় বিদ্যমান চরম দূরাবস্থায় উপরোক্ত দু’টি উক্তি চরমভাবে প্রণিধানযোগ্য।
পৃথিবীতে এমন কোন সভ্যতা খুঁজে পাওয়া যাবেনা যেখানে আইনের বিকাশ হয়নি। সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে ‘আইন’ ধারনাটিরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তিত সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে আইন তার কার্যকারীতা হারায়। প্রয়োজন হয় সে আইনকে সময় উপযোগী করে তোলা। গঠনমূলক সমালোচনার মধ্যেই আইন তার অস্তিত্বের সন্ধান পায়। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয়, আমাদের পুরো আইনব্যবস্থায় রয়েছে বৃটিশদের শঠতার ছোঁয়া। কারণ বৃটিশ তাদের দুষ্কর্ম ঢাকতে আইন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। তৎকালীন ভারতবর্ষের গভর্ণর জেনারেল ১৭৭২ সালে আইন ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করে তিনিই সর্বপ্রথম আইন ভঙ্গ করেন। তার অধস্থন কর্মচারী জার্মান চিত্রশিল্পীর পরমা সুন্দরী স্ত্রীকে দাঁড়িপাল-ায় বসিয়ে স্বর্ণের দামে খরিদ করেছিলেন। আজকের আদালতে ব্যবহৃত ন্যায় বিচারের প্রতীক দাঁড়িপাল¬াকে তিনিই প্রথম অনৈতিক কাজে ব্যবহার করেন। মূলত বৃটিশ আইন তৈরী করেছিল শাসন শোষনের জন্য, দরিদ্র কৃষকের জমির খাজনা আদায়ের জন্য কিংবা প্রজাকে কাচারীতে ধরে নিয়ে মারধর, হাত-পা বেঁধে আঁধার কুঠুরিতে ফেলে রাখা, প্রজার স্ত্রী-কন্যাকে বন্ধক হিসেবে আটক রাখা, বিষয় সম্পত্তি ক্রোক করা এবং ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা। বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থা এখনও তার উত্তরাধিকার বহন করছে মাত্র। মোবাইল কোর্ট আইন তাদের মধ্যে অন্যতম।
‘মোবাইল কোর্ট আইন’ ২০০৯ সালের ৬ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করে। এ আইনের ভূমিকায় আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যের বর্ণনায় বলা হয় জনস্বার্থ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপরাধ প্রতিরোধ কার্যক্রমকে কার্যকর ও অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদন করার জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে কিছু অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে আমলে নিয়ে দ-ারোপের সীমিত ক্ষমতা অর্পণ করে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয় হওয়ায় অত্র আইন প্রণয়ন করা হলো।
এ আইনের ৬(১) ধারায় বলা হয় যে অত্র আইনে তফসিলে বর্ণিত আইনের বিধান মোতাবেক কৃত অপরাধের বিচার করতে বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অথবা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষমতাপ্রাপ্ত বটে। এ আইনের তফসিলে সর্বমোট ৬৫টি আইন উল্লেখিত আছে। এ আইনে সর্বমোট ১৭টি ধারা সন্নিবেশিত আছে।
মোবাইল কোর্ট পরিচালনার পদ্ধতি বর্ণিত আছে ৭ ধারায়। ৭ ধারায় বলা হয়, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগ আমলে নেওয়ার পর সংক্ষিপ্ত চার্জ গঠন করে তা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পড়ে শোনাবেন। অতঃপর অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করবেন তিনি অভিযোগ স্বীকার করেন কি-না। অভিযুক্ত ব্যক্তি অভিযোগ স্বীকার না করে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অব্যাহতি দেবেন [৭ (৩) ধারা]। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তি অভিযোগ স্বীকার করলে তাঁকে দ- প্রদান করবেন [৭(২) ধারা]। অভিযোগ স্বীকার করলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দুইজন সাক্ষীর স্বাক্ষর বা টিপসই এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির স্বাক্ষর বা টিপসই নেবেন [৭(২) ধারা] বর্ণিত আইনটি আপাতদৃষ্টে একটি চমৎকার আইন মনে হলেও বাস্তবিক পক্ষে Constitutional Norms এবং Principles of Natural Justice-এর সব নীতিমালাকে উপেক্ষা করে এ মোবাইল কোর্ট আইনটি রচিত হয়েছে, যা সবিস্তারে আলোচনা করা হলো।
আমরা সবাই জানি, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত মুখোমুখী বিজ্ঞ বিচারকের সামনে তাঁদের নিযুক্ত আইনজীবী দ্বারা মামলা প্রমাণ বা মিথ্যা প্রমানে আইনি লড়াই করে। উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমানের আলোকে বিজ্ঞ বিচারক তাঁর সুচিন্তিত এবং সুসিদ্ধান্তিত রায় প্রদান করে। অথচ মোবাইল কোর্ট আইন সেই সকল বিষয়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে।
মোবাইল কোর্ট আইনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় আপত্তি হলো আমাদের সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদেও গ্রেপ্তার ও আটকের ব্যাপারে পদ্ধতিগত সুরক্ষা দিয়েছে যেমন ‘গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে যথাশীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া পুনরায় আটক রাখা যাবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাবে না।’ আমাদের পবিত্র সংবিধানের বিধান প্রতিনিয়ত লংঘন হচ্ছে অথচ আমার সুশাসনের কথা বলছি। ফৌজদারি আইনি লড়াই করার জন্য নিযুক্ত বিজ্ঞ আইনজীবী দ্বারা তাঁর Defence Against Charge-এর যে সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার পেয়েছেন তা কোনো যুক্তিতে উপেক্ষা করা হলে সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা বা ধারণা মোবাইল কোর্ট আইনের কোথাও নেই।
মোবাইল কোর্ট আইনের বিরুদ্ধে তৃতীয় আপত্তি হলো এটি সংবিধান স্বীকৃত জনসন্মুখে বিচার অস্বীকার করে। সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদ মোতাবেক Every person accused of a criminal offence shall have the right to a speedy and public trial by an independent and impartial Court or tribunal established by law. বিচার ও দণ্ড প্রদানের প্রাক্কালে কোনো জনসাধরণকে উক্ত স্থানে RAB, Police এবং বিজ্ঞ Executive Magistrate কাউকেই ওই স্থানে থাকতে দেন না। মোবাইল কোর্টের এহেন আচরণ জনসন্মুখে বিচার অস্বীকার করে।
মোবাইল কোর্ট আইনের বিরুদ্ধে চতুর্থ আপত্তি হলো এটি মারাত্মকভাবে সর্বজনীন আইনের ন্যায়পর নীতিমালাকে উপেক্ষা করে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩১ অনুযায়ী’ To enjoy the protection of the law, and to be treated in accordance with law, and only in accordance with law, is the inalienable right of every citizen, wherever he may be, and of every other person for the time being within Bangladesh, and in particular no action detrimental to the life, liberty, body, reputation or property of any person shall be taken except in accordance with law.’ অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার আছে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত সাক্ষ্য অবলোকন করা এবং তা খণ্ডন করা এবং উপস্থাপিত সাক্ষীদের) প্রদত্ত জবানবন্দি জেরা করা। এখানে উল্লেখ্য, জেরা করা ফৌজদারি দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির মৌলিক আইনগত অধিকার। কিন্তু মোবাইল কোর্ট আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দ- প্রদানের ক্ষেত্রে এরূপ কোনো অধিকার প্রয়োগের সুযোগ দিয়ে কোনো বিধান রাখা হয়নি।
মোবাইল কোর্ট আইনের ১৭টি ধারা ভালভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় সার্বজনীন স্বীকৃত ও সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো বিভিন্ন স্তরে ফুটে উঠেছে। যেমন-
ক) কোন সাক্ষ্য উপস্থাপন এবং প্রদর্শনের করার বিধান রাখা হয়নি।
খ) কোনো সাক্ষীর জবানবন্দি উপস্থাপনের বিধান রাখা হয়নি।
গ) অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আনীত অভিযোগের জবাবে জেরা করার বিধান রাখা হয়নি।
ঘ) অভিযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক নিজের সাফাইয়ের জন্য সাফাই সাক্ষী উপস্থাপনের সুযোগ দেওয়া হয়নি।
অথচ উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আসামীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাক্ষীর দ্বারা সমর্থিত না হলে কোনভাবেই আসামীকে দোষী সাব্যস্থ করে সাজা প্রদান করা যাবে না।
মোবাইল কোর্ট আইনের বিরুদ্ধে পঞ্চম আপত্তি হলো এ আইনের অধীন বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট একই সঙ্গে তদন্তকারী, আমল গ্রহণকারী এবং দ- প্রদানকারী বিচারককে তিনটি ভিন্ন ক্ষমতা একই সঙ্গে প্রদান করা হয়। ফলে মোবাইল কোর্টের বিজ্ঞ বিচারক বাংলাদেশ সংবিধানে ৭৭ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘The Ombudsman shall exercise such powers and perform such functions as Parliament may, by law, determine, including the power to investigate any action taken by a Ministry, a public officer or a statutory public authority’ এ অংশটি মারাত্মকভাবে ব্যহত করছে। একই ব্যক্তি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা একই সঙ্গে অর্জন করার ফলে একটা অযাচিত একনায়কতন্ত্রের- জন্ম হওয়াই স্বাভাবিক।
মোবাইল কোর্ট আইনের ষষ্ঠ আপত্তি হলো এটা Judicial Magistrate এবং Executive Magistrate-এর মধ্যকার পার্থক্য রেখা ম্লান করে দিয়েছে। যেমন- মোবাইল কোর্ট আইনের ৮(১) ধারা মোতাবেক বিজ্ঞ Executive Magistrate সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দিতে পারেন। ফৌজদারি কার্য সংহিতার ধারা ৩২(গ) মোতাবেক বিজ্ঞ Judicial Magistrate of the 3rd Class সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড দিতে পারেন। কিন্তু অদ্ভুত বিধান এই যে Executive Magistrate আইনে স্বীকৃত যেকোনো অর্থ দণ্ড দিতে পারে অথচ বিজ্ঞ Judicial Magistrate of 3rd Class ২০০০ টাকার ওপরে অর্থদণ্ড দিতে পারে না। Executive Magistrate Judicial Magistrate না হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে Judicial Magistrate -এর চেয়ে অধিক অর্থদণ্ডই প্রদানের ক্ষমতা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং Separation of Judiciary-এর নীতিমালার সম্পূর্ণ লঙ্ঘন ও পরিপন্থী। এখানে উল্লেখ্য, Executive Magistrate-কে সংবিধান মোতাবেক একজন Ombudsman-এর মতো ক্ষমতা প্রদান করার কোনো যৌক্তিক কারণ বা ব্যাখ্যা এ আইনে নেই। অধিকন্তু Executive Magistrate বিচারিক হাকিম তথা Judicial Magistrate না হওয়া সত্ত্বেও কেন তাঁকে Judicial Magistrate-এর চেয়ে অধিক অর্থদণ্ড আরোপের ক্ষমতা প্রদান করা হলো তারও ব্যাখ্যা বা কারণ বর্ণিত হয়নি।
মোবাইল কোর্ট আইনের সপ্তম আপত্তি হলো আলোচ্য আইনটি মানবাধিকার আইনের পরিপন্থী। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ মোতাবেক ’The Republic shall be a democracy in which fundamental human rights and freedoms and respect for the dignity and worth of the human person shall be guaranteed and in which effective participation by the people through their elected representatives in administration at all levels shall be ensured].’ মোবাইল কোর্ট আইনে যেহেতু অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কোনো সময় মঞ্জুরের ব্যবস্থা নেই। এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ ও বিধান দুটোই নেই, সেহেতু মোবাইল কোর্ট আইন নিঃসন্দেহে মানবাধিকার আইনের নীতিমালার সঙ্গে মারাত্মক সাংঘর্ষিক। মানবাধিকার আইনের নীতিমালা মতে, একজন অভিযুক্তকে অবশ্যই নিম্ন লিখিত সুযোগ দিতে হবে।
ক) সুস্পষ্ট অভিযোগ লিখিতভাবে আনতে হবে।
খ) অভিযোগ সমর্থনে প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে।
গ) অভিযোগ প্রমাণে সাক্ষীদের জবানবন্দি নিতে হবে।
ঘ) অভিযুক্তকে অভিযোগকারী ও তাঁর সাক্ষীদের জেরার সুযোগ দিতে হবে।
ঙ) অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য প্রস্তুুতির পর্যাপ্ত সুযোগ ও সময় দিতে হবে।
চ) অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজ পছন্দ মোতাবেক বিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগের এবং পরামর্শ গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।
ছ) আত্মপক্ষ সমর্থনে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সাক্ষ্য ও সাক্ষী উপস্থাপনের সুযোগ দিতে হবে।
কিন্তু আলোচ্য আইনটি পুরোপুরি বিচার বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ওই আইন ওপরে বর্ণিত সব নীতিমালা উপেক্ষা করে সরকারের একটি বিশেষ শ্রেণীর কর্মকর্তাদের খুশি করার জন্য ঝটপট আলোচ্য আইনটি প্রণয়ন করে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না যে ইতিহাসের কোনো আইন মানবতা বিমুখ হয়ে দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারি।
যে আইন মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে না, যে আইন ন্যায়পর নীতিমালা রক্ষা করতে পারে না, যে আইন সংবিধান সমুন্নত রাখতে পারে না, যে আইন সব স্বচ্ছতা, যৌক্তিকতা এবং পদ্ধতিগত সংহতি রক্ষা করতে পারে না, সেই আইন আর যাই হোক জনস্বার্থ রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম এ কথা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক অবকাশ নেই।
একথা সত্য, মোবাইল কোর্ট আইন বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, মাদক, বালু উত্তোলন বা খাস জমি দখলের একাধিক ঘটনা এবং সফল ভেজালবিরোধী অভিযান চালিয়ে মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের প্রাণঘাতী কর্মতৎপরতা অনেকাংশে ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রতিরোধ কর্মে অনুসৃত আইনটিতে আইনের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ ও পর্যুদস্ত করবে।
Discussion about this post