বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ১৯ মাস পর গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর নবম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (বিজেএস) পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করা হয়। এতে ১০০ জন প্রার্থী উত্তীর্ণ হন। কিন্তু এখনো গেজেট না হওয়ায় তাঁরা সহকারী জজ পদে চাকরিতে যোগ দিতে পারছেন না। অর্থাৎ প্রায় ২৮ মাসেও নবম বিজেএসের নিয়োগ-প্রক্রিয়া শেষ হয়নি।
আইন মন্ত্রণালয় এবং জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন বলছে, সবকিছু শেষ হলেও দুটি সংস্থার যাচাই প্রতিবেদনের প্রক্রিয়া শেষ না হওয়ায় গেজেট প্রকাশ করা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দুই দফায় চিঠি দিয়ে তাগাদাও দেওয়া হয়েছে।
২০০৮ সালে তৃতীয় বিজেএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের মাত্র দুই মাসের মধ্যে ৩৯০ জন প্রার্থীর গোয়েন্দা যাচাই প্রক্রিয়া শেষ হয়েছিল। ২০০৯ সালে চতুর্থ বিজেএসে উত্তীর্ণ ২১২ জনের যাচাই প্রতিবেদন চার মাসে শেষ হয়েছিল। এই দুবারে নিয়োগ-প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লেগেছিল কম। কিন্তু এরপর থেকে প্রতিটি বিজেএসের নিয়োগ শেষ করতে ক্রমশ সময় বাড়ছে।
এই দীর্ঘসূত্রতায় হতাশ ও ক্ষুব্ধ প্রার্থীরা। তাঁরা বলছেন, বিসিএস পরীক্ষায় দুই লাখেরও বেশি প্রার্থী অংশ নেন। এই নিয়োগ-প্রক্রিয়া শেষ করতে দুই বছর লাগে। ৩১ ও ৩২তম বিসিএসের নিয়োগ-প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে দুই বছরেরও কম সময়ে। কিন্তু বিজেএসে আড়াই বছরও লেগে যাচ্ছে। অথচ এখানে প্রার্থীসংখ্যা কয়েক হাজার। চূড়ান্ত ফলে উত্তীর্ণ প্রার্থী সংখ্যাও বিসিএসের চূড়ান্ত ফলে উত্তীর্ণদের চেয়ে অনেক কম।
জানতে চাইলে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের সচিব (জেলা জজ) পরেশ চন্দ্র রায় গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নবম বিজেএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের তালিকা এ বছরের শুরুতেই আমরা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। সেখান থেকে যাচাইয়ের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু সেই প্রতিবেদন না আসায় গেজেট প্রকাশ করা যাচ্ছে না। প্রতিবারই এ কারণে নিয়োগে বিলম্ব হচ্ছে।’
কমিশন সূত্র বলেছে, ২০১৪ সালের ২৯ মে নবম বিজেএসের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। ওই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক বাছাই (প্রিলিমিনারি) পরীক্ষায় অংশ নেন ৩ হাজার ১৯৪ জন। উত্তীর্ণ ১ হাজার ৪৯৬ জনের লিখিত পরীক্ষা হয় গত বছরের ১০ এপ্রিল থেকে ২ মে পর্যন্ত। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৪১৩ জনের ১ থেকে ১৮ ডিসেম্বর মৌখিক পরীক্ষা শেষে ৩১ ডিসেম্বর চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়।
প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা পদে নিয়োগ হয় সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে। তবে সহকারী জজ নিয়োগের সব প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন (জেএসসি)। বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পর ২০০৭ সালে এই কমিশন গঠিত হয়।
এরপর জেএসসির সভায় ২২তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে সহকারী জজ পদে নিয়োগ পাওয়াদের প্রথম বিজেএস ব্যাচ এবং ২৪তম বিসিএস পরীক্ষায় ওই পদে উত্তীর্ণদের দ্বিতীয় বিজেএস হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জেএসসি প্রথমবারের মতো সহকারী জজ নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ২০০৭ সালের আগস্টে। সব পরীক্ষা শেষে ছয় মাসের মধ্যে ২০০৮ সালের ১৭ মার্চ চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়। উত্তীর্ণ ৩৯০ জন ২২ মে চাকরিতে যোগ দেন। এটি তৃতীয় বিজেএস ব্যাচ।
২০০৯ সালের ৩ জানুয়ারি চতুর্থ বিজেএসের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয় এর প্রায় ১৬ মাস পর। ২১২ জনের যাচাইয়ে লাগে চার মাস। এই নিয়োগ-প্রক্রিয়া শেষ হয় ২০ মাসে। ২০১০ সালের ২৪ জুন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা পঞ্চম বিজেএসে নিয়োগ পান ১২০ জন। এই নিয়োগে ২৬ মাস লেগেছে, এর মধ্যে যাচাইয়ে লাগে ১১ মাস।
ষষ্ঠ বিজেএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় ২০১১ সালের জুনে। ১২৫ জনের এই ব্যাচের নিয়োগে লাগে ২৮ মাস। এর মধ্যে যাচাইয়ে যায় ১৪ মাস। সপ্তম বিজেএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় ২০১২ সালের ২৬ জুলাই। এই ব্যাচে ৬৭ জনকে নিয়োগেও ২৮ মাস লাগে। এর মধ্যে যাচাই প্রতিবেদনে যায় ১০ মাস। এ নিয়ে তখন প্রথম আলোয় ‘আড়াই বছরেও শেষ হয়নি সহকারী জজ নিয়োগ-প্রক্রিয়া’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
অষ্টম বিজেএসে ৫৩ জনের নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় লাগে ২৯ মাস। এর মধ্যে যাচাইয়ে লাগে প্রায় ১১ মাস।
বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ২৮ মাস পরও নবম বিজেএসের নিয়োগ-প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। আর দশম বিজেএসের লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে গত ৯ আগস্ট। চলতি বছরের শেষেই ১১তম বিজেএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে।
ক্ষুব্ধ প্রার্থীরা: নবম বিজেএসে উত্তীর্ণ ১৫ জন এবং দশম বিজিএসে অংশ নেওয়া ১০ জনের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়েছে। বিজেএসের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়ে বিচারক হিসেবে কর্মরত ১৫ জনের সঙ্গেও এ নিয়ে কথা হয়েছে। তাঁরা নিয়োগ-প্রক্রিয়ার এই দীর্ঘসূত্রতায় ক্ষোভ জানিয়েছেন।
নবম বিজেএস উত্তীর্ণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী বলেন, ১০০ জনের যাচাই প্রতিবেদন দিতে এক মাসের বেশি কোনোভাবেই লাগার কথা হয়। অথচ নয় মাসেও তা হচ্ছে না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে পাস করা এক ছাত্র বলেন, ‘স্নাতক (সম্মান) শেষ করেই পরীক্ষা দিয়েছি। চাকরি পেয়েছি শুনে বাবা-মা খুব খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু নিয়োগ পেতে দেরি হওয়ায় তাঁরাও এখন হতাশ।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র বলেন, ‘পিএসসির আবেদন-প্রক্রিয়া হয় অনলাইনে। কিন্তু বিজেএসের সবকিছু এখনো পুরোনো পদ্ধতিতে হয়। ফলে সময় বেশি লাগে। বিজেএসে ১০টা বিষয়ের কঠিন সিলেবাসের লিখিত পরীক্ষা হয়। যেহেতু নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় বেশি সময় লাগে তাই দুই বিষয়ের পরীক্ষার মধ্যে সময়ের ব্যবধান বাড়ানো হোক। এতে প্রার্থীদের দুর্ভোগ কমবে।’
তিনজন যুগ্ম জেলা জজ প্রথম আলোকে বলেন, উত্তীর্ণ প্রার্থীরা যত দ্রুত চাকরিতে যোগ দিতে পারবেন, ততই মামলাজট কমবে। কিন্তু নিয়োগের দীর্ঘসূত্রতায় সেটি হচ্ছে না।
আইন মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলেছে, গত এপ্রিলে গোয়েন্দা সংস্থার যাচাইয়ের জন্য উত্তীর্ণ ১০০ জনের তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু এখনো প্রতিবেদন না আসায় আইন মন্ত্রণালয় দুবার তাগাদা দিয়ে চিঠিও দিয়েছে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা শাখার যুগ্ম সচিব সাহেদ আলী গত সোমবার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন এলেও আরেকটির আসেনি। সেটি এলেই ছাড়পত্র দেওয়া হবে।’
আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) বিকাশ কুমার সাহা বলেন, ‘দ্রুত যাচাই প্রতিবেদন দিতে আমরাও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলছি। কারণ, উত্তীর্ণরা দ্রুত যোগ দিতে পারলে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ দ্রুত কমবে।’ সূত্র: শরিফুল হাসান/প্রথম আলো
Discussion about this post