সাঁওতাল-অধ্যুষিত গ্রাম দুটির নাম মাদারপুর ও জয়পুর। গত রোববারের বিকেল, সন্ধ্যা ও রাত ছিল এ দুটি গ্রামের মানুষের জন্য বিভীষিকাময়। সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি-অভিজ্ঞতা তাড়িয়ে ফিরছে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারসংলগ্ন গ্রাম দুটির মানুষকে।
গত রোববার জমির আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধ একজন ওই রাতেই মারা যান। পরদিন রাতে ধানখেত থেকে আরেক সাঁওতালের লাশ উদ্ধার করা হয়। গ্রামবাসীর ধারণা, তিনি ওই সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে খেতে পড়ে ছিলেন। পরে মারা যান। আহত হন ১৮ জন।
সাঁওতাল পরিবারগুলোর ঘর পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি। কারা আগুন দিল, কীভাবে লুটপাট চালানো হলো, তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটিও হয়নি।
গতকাল বুধবার বেলা ১১টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত গ্রাম দুটি পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, মাটির তৈরি বাড়িগুলোর অধিকাংশ ফাঁকা। সাঁওতালদের যে কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা ঘরে আছেন, অজানা আতঙ্কে তাঁরা ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। মাঝেমধ্যে কোনো কোনো ঘর থেকে কেউ কেউ উঁকি দিচ্ছেন। বয়স্ক অনেক মানুষকে শুয়ে-বসে থাকতে দেখা গেলেও তাঁদের মুখে কোনো কথা নেই। তাঁদের সন্তানেরা ভয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও যাচ্ছে না। দুটি গ্রামেরই পরিস্থিতি থমথমে।
গ্রাম দুটির অধিকাংশ মানুষকে পাওয়া গেল মাদারপুর গির্জার সামনের মাঠে। সবার চোখেমুখে হতাশা, আতঙ্ক। অপরিচিত লোক দেখলে ভয় পাচ্ছেন। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর তাঁরা কথা বলা শুরু করেন।
মাদারপুর গ্রামের সাঁওতাল পরিবারের এক গৃহিণী ছানি বাস্কে (৩৫) বলেন, ‘আমাদের ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। শাড়ি কাপড়, ৫টি ছাগল, ২০টি মুরগি, ৬টা হাঁস ও চাল-ডাল পুড়ে গেছে। আমাদের এখন খাবার নেই। আইজ (গতকাল) সকালে লবণ-চা খেয়েছি। দুপুর-রাতে কী খাব বুদ্ধি নাই। চার বছরের মেয়েকেও কী খাওয়াব চিন্তায় আছি।’ তাঁর পাশে বসে থাকা মুখি মুরমু (৪৫) বলেন, ছেলে রিপন মুরমু নাইনে পড়ে। ওর বই-খাতা পুড়ে গেছে। স্কুল যাওয়াও বন্ধ।
একই স্থানে গালে হাত দিয়ে বিষণ্ন মনে বসে ছিলেন ফেরেজা বাস্কে (৪০)। তিনি বলেন, তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া সন্তান সীমান্ত মুরমুর বই-খাতা, স্কুলব্যাগ, কাপড়সহ অন্য জিনিসপত্র পুড়ে গেছে। দুইটা গরু, হাঁড়িপাতিল লুট হয়েছে।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মাদারপুর গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ্ব নারী জোবা টুডু বললেন, ‘যুদ্ধের (রোববারের ঘটনা) পর থেকে আমরা বন্দী। গ্রাম থেকে বাইরে যেতে পারছি না। এখন বড় অসহায়। আমাদের পাশে কেউ এসে দাঁড়াতেও চাইছে না।’
জয়পুর গ্রামের নারী মেরি টুডু (৫৫) বলেন, ‘স্বামীর অসুস্থতার কারণে আমাকে সংসারের কাজ করতে হয়। কিন্তু আমরা ভয়ে কোথাও যেতে পারছি না। খাওয়ার চাল ফুরিয়ে গেছে।’ ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়ে গোড়ান সরেন (৪০) বলেন, ‘আমাদের ঘর পুড়ল, গরু-ছাগল লুট হলো। এর বিচার কে করবে? আমাদের কেই-বা সাহায্য করবে?’
সাহেবগঞ্জ ফার্ম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল বাকি বলেন, সাঁওতাল পরিবারের ৬০ জন শিক্ষার্থী এই স্কুলে পড়ছে। তারা এখন আসছে না।
তবে ঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল আউয়াল বলেন, ‘আমাদের কোনো শ্রমিক-কর্মচারী আগুন দেননি। উচ্ছেদের সুযোগে অন্য কেউ এ ঘটনা ঘটিয়েছে।’
গোবিন্দগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুব্রত সরকার বলেন, ‘ঘরে আগুন ও লুটপাটের ঘটনায় সাঁওতালদের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ দেওয়া হয়নি। কারা আগুন দিয়েছে, তা আমরা জানি না।’ সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post