একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর পক্ষে সাক্ষী দিতে পারছেন না তার পাকিস্তানি বন্ধুরা।
সোমবার (০২ নভেম্বর) প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিলবেঞ্চ সাকার পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণের আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন।
সাকা চৌধুরীর পক্ষে চার পাকিস্তানি নাগরিকসহ সাতজন রিভিউ শুনানিতে সাফাই সাক্ষ্য প্রদানের অনুমতি চেয়ে ১৯ অক্টোবর সোমবার সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় আবেদন করেন তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট হুজ্জাতুল ইসলাম খান আল ফেসানী।
আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের মৌখিক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আজ সোমবার প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ সাকা ও মুজাহিদের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন (রিভিউ) শুনানি নির্ধারণ করে দেন ১৭ নভেম্বর। একইসঙ্গে দু’জনের পক্ষে আদালতে যে কয়টি আবেদন করা হয় সব আবেদনই খারিজ করে দেয়া হয়।
আপিল বিভাগের এই বেঞ্চের অপর তিন বিচারপতি হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
আদালত থেকে বেরিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
সাকা ও মুজাহিদের পক্ষে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন এবং রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এসময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
সাকার পক্ষে করা আবেদনে ওই সাত সাক্ষির মধ্যে পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মিয়া সুমরো, পাকিস্তানের সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রিপরিষদ মন্ত্রী ইসহাক খান খাকওয়ানি, ফিজিতে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ওসমান সিদ্দিকের নাম রয়েছে। দু’জন ব্যবসায়ীও রয়েছেন। এছাড়াও বাংলাদেশের হাইকোর্টের বিচারপতি শামীম হাসনাইন ও তার মা সাকার পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার আবেদন জানান।
নতুন আবেদন করা সাক্ষিরা মনে করেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ব্যাপারে তৎকালীন ঘটনার ব্যাপারে প্রকৃত সাক্ষ্য দিতে পারলে তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে মুক্ত করা সম্ভব।
মুনীব আর্জমান্দ খান নামের এক পাকিস্তানি পোশাক ব্যবসায়ী বলেন, তার সাক্ষ্য আদালতের দেয়া সিদ্ধান্তকে পুরোপুরি পরিবর্তন করে দিতে পারে।
তিনি জানান, সাকা চৌধুরী তার একজন সহপাঠি এবং বাল্যবন্ধু। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ অর্থাৎ ঢাকায় পাকবাহিনী কর্তৃক শুরু হওয়া অপারেশন সার্চলাইটের ঠিক তিনদিন পর তিনিই করাচি বিমানবন্দর থেকে সাকাকে হারুন পরিবারের কাছে পৌঁছে দেন। এর তিন সপ্তাহ পর সাকা লাহোরে পড়াশুনার জন্য যেতে চাইলে তিনি লাহোরের একটি বিমানে তাকে তুলে দেন। আমরা শুধু সত্যটাই বলতে চাই; ওই তিন সপ্তাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এপ্রিল ১৩ এবং ১৭ তে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়েছে সাকার বিরুদ্ধে অথচ যখন তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করছিলেন।
পাকিস্তানের করাচি ভিত্তিক একটি গণমাধ্যমের স্বত্বাধীকারী গ্রুপের প্রধান এবং পাকিস্তানের সেরা ধনাঢ্য ব্যবসায়ী অ্যাম্বার হারুন সায়গল নামের এক নারী জানান, ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল ২০ বছর। ওই সময় মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের মধ্যভাগ পর্যন্ত সাকা চৌধুরী তাদের করাচির বাসায় অবস্থান করছিলেন। তারা প্রায়ই রাতের খাবারের টেবিলে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতেন। এটাই বাস্তব সত্য। একজনের প্রাণ রক্ষার্থে আমি বাংলাদেশে গিয়ে সত্যটা তুলে ধরবো, যদি আদালত আমাকে সেই সুযোগ দান করেন।
পাকিস্তানের ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মিয়া সুমরো বলেন, ওই তিন সপ্তাহ সাকা করাচিতে অবস্থান করছিলেন। তার সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই সাকার সাক্ষাৎ হতো। সেখান থেকে সাকা লাহোরে পড়াশুনার উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন।
সাকার রায়কে একটি ‘নিষ্পাপ’ ব্যক্তির প্রতি মহান আদালতের অবিচার আখ্যা দিয়ে তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে এসে তিনি শপথের ভিত্তিতে সত্য প্রকাশে আগ্রহী।
তবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম একে নজীরবিহীন বলে আখ্যায়িত করেন। রিভিউ আবেদনের সময় শেষ হওয়ার কারণে নতুন সাক্ষি অন্তর্ভূক্তির কোনো সুযোগ নেই বলেও জানান বাংলাদেশের এই প্রধান আইন কর্মকর্তা।
২০১৩ সালের ১ অক্টোবর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। বিএনপির এই নেতার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ২৩টি অভিযোগের মধ্যে চারটিতে (অভিযোগ নং- ৩, ৫, ৬ ও ৮) তাকে ওই শাস্তি দেয়া হয়। এছাড়া তিনটি (অভিযোগ নং- ২, ৪ ও ৭) অভিযোগে তাকে ২০ বছরের ও দুটি (অভিযোগ নং- ১৭ ও ১৮) অভিযোগে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
এরপর নিয়মমাফিক সাকাও ওই রায়ের বিরুদ্ধে যান আপিল বিভাগে। তবে সেখানেও তার সর্বোচ্চ সাজার রায়ই বহাল থাকে। ৩০ সেপ্টেম্বর মুজাহিদের সঙ্গে তারও মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেন আপিল বিভাগ। এরপর দুজনের রায়েরই পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি একসঙ্গে আসে ট্রাইব্যুনালে। গত ১ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করলে তা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে দেয়া হয়।
উল্লেখ্য, রিভিউ খারিজ হলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা করতে হবে সাকা চৌধুরীকে।
Discussion about this post