সিডনির অলিন্দে মুখোমুখি দু’দেশের সব চেয়ে বিতর্কিত এবং সমালোচিত অধিনায়কেরা

4
VIEWS
Michael Clarke and MS Dhoni

গ্রান্ট এলিয়ট ছক্কাটা মারার কয়েক মিনিটের মধ্যে ভারতীয় শিবিরে দু’একজনের মধ্যে একটা টেক্সট মেসেজ চালাচালি শুরু হল। যার বয়ান— কার্স্টেনের বুদবুদ আরও উবে যেতে বসেছে।

আধুনিক ভারতীয় শিবিরে আসলে গ্যারি কার্স্টেনকে নিয়ে একটা দার্শনিক তর্ক আছে। তর্কের বিষয়, ভারতের দু’হাজার এগারোর বিশ্বকাপ জয়ে ডে’ভিলিয়ার্সের টিমের প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা কতটা ছিল? প্রায় সকলেরই ধারণা, অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল এবং তাই কার্স্টেন চলে যেতেই ভারতের যত বিপর্যয়ের সূচনা। তারকা রণবীর কপুর তো জয়ের উল্লাসে টুইটই করে দিয়েছিলেন যে, ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের সামনের রাস্তা ডি রোডের নামকরণ হোক কার্স্টেনের নামে।

ভারতীয় ড্রেসিংরুম যে মনোভাবের সঙ্গে একমত হতে পারেনি। তারা বারবার অস্ফুটে বলছিল, জয়ের নেপথ্যে সচিনের টিমকে উজ্জীবিত রাখা আর ধোনির বরফশীতল মস্তিষ্ক। মঙ্গলবার অকল্যান্ডে দক্ষিণ আফ্রিকার ফের ভাগ্য বিপর্যয়ের পর গুরু গ্যারির ঔজ্জ্বল্য ভারতীয় ড্রেসিংরুমে আরও কমল। তিনি এ বার নিয়ে টি-টোয়েন্টি, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ও বিশ্বকাপ মিলে তিন বার হারলেন ধোনির ভারতের কাছে। এমসিজিতে যা-ও বা সুযোগ আসতে পারত, সেটাও গেল। এক রকম প্রমাণই হয়ে গেল যে ধোনিই সংসারের বড় কর্তা। বরাবর ধোনিই ছিলেন। এবং যতটা মনে করা হচ্ছিল ততটা কিছু ভূমিকা ছিল না গুরু গ্যারির!

কারও সর্বনাশ, কারও পৌষ মাস! অকল্যান্ডে দক্ষিণ আফ্রিকার হার ধোনি মডেলকে আরও চিত্তাকর্ষক মোড়ে নিয়ে গিয়েছে। প্রায় প্রতি দিনই অস্ট্রেলিয়ান কাগজে তাঁর নেতৃত্বের ধরন ও কার্যকারিতা নিয়ে কিছু না কিছু বার হচ্ছে। মিডিয়া সবচেয়ে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে ধোনির সর্ব পরিস্থিতিতে নাটক বিবর্জনী ক্ষমতা দেখে। নিজের বাচ্চা হয়েছে দু’মাসেরও বেশি। কিন্তু বিশ্বকাপ বলে আজও দেখতে যাননি। প্রসঙ্গ উঠলে তবে না বলেছেন, “আয়্যাম হিয়ার অন ন্যাশনাল ডিউটি। কাজ ছেড়ে যেতে পারব না।” ব্যস আর একটা কথাও না। টেস্ট ম্যাচ থেকে রিটায়ার করার কথা সাংবাদিক সম্মেলনে বলেননি। পরে বোর্ড মিডিয়া রিলিজ পাঠিয়ে জানিয়েছে। অজি সাংবাদিকেরা সে দিনও বলেছেন, এ জিনিস তাঁরা দেখেননি।

একই সঙ্গে তাঁদের স্বগতোক্তি, ক্লার্কের ওয়ান ডে অবসরের পরেও এর পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা। মাইকেল ক্লার্ক এবং মহেন্দ্র সিংহ ধোনি বৃহস্পতিবার ক্রিকেট-গ্রহের সবচেয়ে রোমহর্ষক লড়াইয়ে যুযুধান হলেও আসলে ওঁদের মধ্যে মিল অনেক বেশি। সংঘর্ষ কম। প্রথমত ওঁরা কেউ খুব জনপ্রিয় নন নিজের সার্কিটে। আর সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতেও রাজি নন। কেউ জানে না ওঁদের পরের পদক্ষেপ কী হবে? অস্ট্রেলীয় মিডিয়ার ধারণা, ক্লার্ক বিশ্বকাপ জিতলেও অবসর নিতে বাধ্য হবেন। বোর্ড এবং নির্বাচকেরা প্রচণ্ড রুষ্ট তাঁর ওপরে। ভারতীয় ক্রিকেট-জগতে তেমন কারও কারও মনে হচ্ছে, কাপ জিতলে ধোনি না রিটায়ার করে ফেলেন! যা উড়িয়ে দিয়ে রবি শাস্ত্রী মঙ্গলবার বললেন, “যত বাজে গুজব। এমএস এখনও তিন-চার বছর খেলবে।”

বললেও ছবিটা বিশেষ বদলাল না। সবাই জানে ধোনি চরিত্র হিসেবে প্রয়োজনে এমনই বেপরোয়া যে দিল্লিতে যেমন আজও বাইক নিয়ে হাইওয়েতে নেমে পড়তে পারেন, তেমনই অকাতরে ছেড়ে দিতে পারেন অধিনায়কত্ব। আর ক্লার্কের প্রস্থান তো সর্বস্তরে চাওয়াই হচ্ছে। কিন্তু তিনিও এমন বেপরোয়া যে এ দেশীয় সাংবাদিকেরা কাগজে পূর্বাভাস দিতে ভয় পাচ্ছেন। আজ সিডনিতে গোটা দুপুর জুড়ে বৃষ্টি হল। কিন্তু পরশু বৃষ্টি নয়, মেঘলা থাকার আশঙ্কা। এটুকু পূর্বাভাস তো করাই যায়। কিন্তু ক্লার্কের ব্যাপারটা হল, কেউ যদি লিখে ফেলে ওঁকে চলে যেতে হচ্ছে। তা হলে স্রেফ ওই লেখাটাকে ভুল বানানোর আক্রোশে তিনি পদ ছাড়বেন না। এ দিনও সিডনি প্রেসবক্সে সিনিয়র অজি সাংবাদিক পিটার ল্যালার বলছিলেন, “কাপ হাতে তুললে যদি তোর চলে যেতে সুবিধে হয় তা হলে ওটা হাতে নিয়ে নে বাবা। কিন্তু যা। যা।”

এ রকম আক্রোশ ও সমালোচনা দু’দেশের ইতিহাসেই কোনও অধিনায়ক একই সঙ্গে বহন করেননি। দেশে বাদ পড়া চার দু’হাজার এগারো তারকা কি ভারত অধিনায়ক সম্পর্কে খুব উচ্ছ্বসিত নাকি? গম্ভীর-যুবরাজ-হরভজন-সহবাগ? তাঁরা কি কচি খোকা যে জানেন না নিছক নির্বাচকেরা তাঁদের বাদ দেননি? ক্লার্কেরও একই অবস্থা প্লেয়ার মহলে। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের বিকেন্দ্রীকরণ অনুযায়ী ক্লার্ক এমনিতে স্টিভ ওয় বিরোধী শিবিরে পড়েন। কিন্তু সেই শিবিরেও তিনি দুটো ভাগ করে দিয়েছেন। ক্লার্ক-বিরোধী এবং পক্ষের। পক্ষের একমাত্র ওয়ার্ন। বিরুদ্ধে নাকি সবাই। পন্টিং-ল্যাঙ্গার-কাটিচ। টিমে কেউ কেউ এমনও বলেছেন, তাঁর স্ত্রী কাইলির জন্য ক্লার্ক আরও গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছেন। কাইলি নাকি টিমে বৌদের সঙ্গে সব সময় ‘বসি’ মেজাজে চলেন। নিজেকে এবং নিজের স্বামীকে মনে করেন অস্ট্রেলিয়ার বেকহ্যাম দম্পতি। ধোনিও তাই। প্রাক্তন যাঁরা ধোনির সুখ্যাতি করে চলেছেন কেউ শ্রীনির ভয়ে। কেউ উপায়ান্তর না দেখে। কিন্তু কমবেশি সবাই দিন গুনছেন। এর ভাল সময়টা শেষ হতে দাও। আসছি তার পর।

ধোনি সম্পর্কে একদা তাঁর সহ খেলোয়াড়দের বিস্তর অভিযোগ ছিল। এই টিমে নেই। ক্লার্কের এই টিমেও আছে। ওয়াটসন। অ্যাডিলেড ম্যাচ জিতে উঠে ক্লার্ক যে ওয়াটসনের যথেষ্ট প্রশংসা করেননি, সেটা অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটমহলে আলোড়ন তুলেছে। তাদের বক্তব্য, ওয়াটসনকে তিনি হিংসে করেন তাই লাইমলাইটে আসতে দেবেন না। এই অস্ট্রেলীয় টিমকে মাঠে দেখে বোঝার উপায় নেই যে ভেতরে ভেতরে দুই অংশে কেমন মতবিরোধ হচ্ছে? স্টিভ স্মিথের নেতৃত্বে অন্য অংশটা তৈরি যে, গেট সেট গো বলা হবে আর তারা নতুন বেদীতে বসে পড়বে!

ধোনি-ক্লার্কে আরও মিল, দু’জনেই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ পছন্দ করেন না। পুরোটা নিজের হাতে রাখেন। এই যে ভারত একদিন ট্রেনিং একদিন নেট, এই ছকে গিয়ে মঙ্গলবার নেটেই এল না, এটা ধোনি। নতুন ইন্ডিয়ান জার্সির রং ও ডিজাইন? সেটাও ধোনি। ক্লার্কও টিম সম্পর্কিত বেশির ভাগ ক্ষমতা নিজের হাতে রাখতে চাইতেন। এমনকী দল নির্বাচনও। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাঁর সেই সব ক্ষমতা গিয়েছে। তবু প্র্যাকটিসের সময় ঠিক করা, কোন ভাষ্যকারকে একটু টাইট দিতে হবে তার নাম নির্বাচন, সবেতেই তিনি। দু’জনের সম্পর্কেই কমন অভিযোগ যে, নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ঠিক গুছিয়ে পেছন থেকে করে নেবে। কিন্তু মুখে ভাবটা রাখবে মিষ্টি।

ক্লার্ক এই টুর্নামেন্টে যে ভাবে হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট থেকে ফিরে এসেছেন তা বীরোচিত বললেও কম বলা হয়। ধোনি এ বারের বিশ্বকাপে যা ক্রিকেট খেলছেন তা-ও তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা।

কিন্তু নিজেদের প্রতি মনোভাবে এঁরা এমনই আবহ তৈরি রেখেছেন যে মেঘ কেটে প্রশংসার আলো পুরো বিকশিত হওয়ার সুযোগ নেই। দু’দেশের ইতিহাসেই এত পারফর্মকারী অধিনায়কের সংখ্যা কম। তবু তাঁদের প্রতি আক্রোশে উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়ার আগ্রহীর সংখ্যা আরও কম। ধোনি সম্পর্কে তাঁর সমালোচকেরা বলে থাকেন, ২ এপ্রিল ২০১১-র রাত থেকে পুরো বদলে গেছে। আর ক্লার্ক সম্পর্কে বলা হয়, বরাবরই এ রকম ছিল।

তাঁদের নিজের নিজের দেশের ইতিহাসেই এত বিতর্কিত, সমালোচিত অথচ একই সঙ্গে এত সফল অধিনায়কের সংখ্যা হাতে গুনে বলা যায়। ধোনি তো সফলতমই। তবু অবিমিশ্র প্রশংসার ভাগ্যই নেই। ক্লার্ক তো ফিল হিউজ এবং তাঁর পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নন। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটমহলে কেউ কেউ প্রকাশ্যেই বলেছেন, ক্লার্ক এটা করেছে কারণ ও জানে এতে জনতার মধ্যে ওর ভাবমূর্তি ভাল হবে।

সমালোচনা আর শত্রুতা কোথাও যেন একই সুতোয় এনে মিলিয়ে দিয়েছে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী অধিনায়ককে। কাকতালীয়ই যে, তাঁরা একে অপরের বিপক্ষে টস করতে নামবেন আর আটচল্লিশ ঘণ্টা বাদে।

সৌজন্যে আনন্দবাজার পত্রিকা

Next Post

Discussion about this post

নিউজ আর্কাইভ

May 2024
S S M T W T F
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031

Welcome Back!

Login to your account below

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.