প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা
বাংলাদেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে গত ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি আমি দায়িত্ব গ্রহণ করি। প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের শুরু থেকে বিচার ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নে সাধ্যমতো কাজ করছি। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিচার বিভাগের ভূমিকা অপরিহার্য। মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার রক্ষা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার— সর্বোপরি আইনের শাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। সংবিধানে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ : আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের দায়িত্ব এবং স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে। বিচার বিভাগের কর্মদক্ষতার ওপর একটি দেশের সভ্যতার চরিত্র প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। অন্য কথায় বলা যায় যে, কোনো দেশের সরকারের কৃতিত্ব পরিমাপ করার সর্বোত্তম মাপকাঠি হচ্ছে তার বিচার বিভাগের দক্ষতা ও যোগ্যতা। জর্জ ওয়াশিংটনের কথার প্রতিধ্বনি করে বলা যায় যে—Administration of justice is the firmest pillar of government. Law exists to bind together the community; it is sovereign and cannot be violated with impunity.
রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য নীতির প্রতিফলন হচ্ছে সংবিধানের মূল চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিচার বিভাগ এর সীমার বাইরে গিয়ে অন্য বিভাগের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। তেমনিভাবে আমিও প্রত্যাশা করি রাষ্ট্রের অন্যান্য বিভাগ বিচার বিভাগের দায়িত্ব পালনে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করবে না। প্রত্যেক বিভাগকে দেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে থেকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে অপরিহার্যভাবে সৃষ্ট শীতল সম্পর্ককে ইতিবাচক দৃষ্টিতে গ্রহণ করলে— প্রত্যেক বিভাগের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটবে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রভূত কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সীমিত সম্পদ ও বাজেট সত্ত্বেও সর্বোচ্চ বিচার সেবা প্রদানে বিচার বিভাগ সাধ্যমতো দায়িত্ব পালন করে জনগণের বিশ্বাস অর্জন করেছে। রাষ্ট্রের ক্রান্তিলগ্নে বিচার বিভাগের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত দেশে-বিদেশে নন্দিত হয়েছে। অধিকন্তু গণতন্ত্র সুসংহত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিচার বিভাগের স্বাধীন মতামত ও সিদ্ধান্ত প্রদান দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে।
বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মামলার জট। মামলা বৃদ্ধির একটি অন্যতম প্রধান কারণ হলো প্রচলিত আইনের অস্বচ্ছতা। ত্রুটিপূর্ণ ও সেকেলে আইনের ফলে মামলার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। দেশের নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত মামলার ভারে জর্জরিত। বিগত দুই বছরে মামলা নিষ্পত্তি বৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে দেশের সকল আদালতে ২৭,৬০,২৪০টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। একই সময় ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে দেশের সকল আদালতে মামলা নিষ্পত্তির পরিমাণ ছিল ২৪,২৩,৮৩৮। বিগত ২ বছরে মামলা নিষ্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে ৩,৩৬,৪০২টি। ফলে নিষ্পত্তির হার শতকরা প্রায় ১৪% বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের উদ্যোগে অধস্তন আদালতের জেলা জজ পর্যায়ের বিচারকদের ছুটি ও কর্মস্থল ত্যাগের বিষয়টি সহজীকরণের লক্ষ্যে e-Application software চালু করা হয়েছে। নতুন এ পদ্ধতির মাধ্যমে ছুটির এ ব্যবস্থা হওয়ায় দ্রুত সময়ের মধ্যে ছুটির বিষয়টি জানা যাবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কতদিন ছুটিতে থাকছেন এ বিষয়ে হিসাব রাখা সহজ হবে। এতে করে অধস্তন আদালতের বিচারকদের ভোগান্তি বহুলাংশে প্রশমিত হবে।
প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দেশের সকল আদালতে চলমান মামলাজট নিরসন ও দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সময় সময় সার্কুলার/Practice Direction ইস্যু করা হচ্ছে। এর ফলে বিচার ব্যবস্থার গতি বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রত্যাশিত মামলার চেয়ে অধিক মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে। জনগণ কম সময়ে দ্রুত বিচার পাচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সুপ্রিম কোর্ট ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে ২০১৬ সালের ২৫-২৬ নভেম্বর পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলন দেশ-বিদেশের স্বনামধন্য বিচারক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞের একটি মিলনমেলায় পরিণত হয়। উক্ত সম্মেলনে পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ এবং বিভিন্ন দেশের আদালতের ভূমিকা, পরিবেশ এবং জলবায়ু সংরক্ষণে গৃহীত পদক্ষেপ এবং তা বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। এতে বিচারকদের মধ্যে পরিবেশ এবং জলবায়ু বিষয়ে একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিদেশি বিশেষজ্ঞ এবং বিচারকগণ সুপ্রিম কোর্টের এরূপ ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন। এতে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হয়েছে। আফগানিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়ার প্রধান বিচারপতিগণ ও এশিয়ার অন্য দেশের উচ্চ আদালতের বিচারপতিগণ এবং UK সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি Lord Robert Cawath আমাদের সুপ্রিম কোর্টের পরিবেশ দেখে ভূয়সী প্রশংসা করেন।
তারা অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন যে, পৃথিবীর বহু উন্নত দেশের সুপ্রিম কোর্টের পরিবেশের সাথে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টকে তুলনা করা যায়।
নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বিচারকগণ আন্তরিকভাবে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করায় বিগত বছরগুলোর তুলনায় মামলা নিষ্পত্তির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। জনসংখ্যার অনুপাতে বাংলাদেশে বিচারকের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। আমেরিকায় ১০ লক্ষ মানুষের জন্য ১০৭ জন, কানাডায় ৭৫ জন, ইংল্যান্ডে ৫১ জন, অস্ট্রেলিয়ায় ৪১ জন, ভারতে ১৮ জন বিচারক রয়েছে। অথচ বাংলাদেশে ১০ লক্ষ মানুষের জন্য মাত্র ১০ জন বিচারক রয়েছে। তদুপরি এই অল্পসংখ্যক বিচারকের জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুযোগ নেই। জনসংখ্যা এবং মামলার সংখ্যা অনুপাতে বিচারক নিয়োগ প্রদান করা এখন সময়ের দাবি।
বর্তমানে আপিল বিভাগে ৮ জন এবং হাইকোর্ট বিভাগে ৮৯ জন বিচারক রয়েছেন। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকগণের মধ্যে ৩ জন বিচারক Inteational Crimes Tribunal-এর বিচারকের দায়িত্ব পালন করছেন। ৪ জন বিচারক গুরুতর অসুস্থ। ফলে বিভিন্ন সময়ে বেঞ্চ গঠনের সময় আমাকে হিমশিম খেতে হয়। এদের মধ্য হতে ২০১৭ সালে ৭ জন বিচারক অবসর গ্রহণ করবেন। ফলে বেঞ্চ গঠনে জটিলতা আরো প্রকট হবে। নিম্ন আদালতের বিচারকের অনুমোদিত পদ সংখ্যা ১৬৫৫; এর মধ্যে ৩৮৭টি পদ শূন্য রয়েছে। অবশিষ্ট ১২৬৮ জন বিচারক দ্বারা নিম্ন আদালতে বিচারাধীন ২৭ লক্ষাধিক মামলা নিষ্পত্তি করা অসম্ভব। তাছাড়া প্রতিদিন নতুন মামলা দায়ের হচ্ছে। সঙ্গত কারণে বর্তমানে শূন্য পদে দ্রুত বিচারক নিয়োগ দেয়া আবশ্যক। বিদ্যমান বিচারক সংখ্যা কমপক্ষে দ্বিগুণ বৃদ্ধি করলে মামলা দায়ের এবং নিষ্পত্তির মধ্যে ব্যবধান বহুলাংশে কমে আসবে মর্মে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
দুই দিনব্যাপী জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলন, ২০১৬ বিগত ২৪-২৫ ডিসেম্বর, ২০১৬ খ্রিঃ অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলন দেশের উচ্চ আদালত থেকে নিম্ন আদালতের সকল বিচারকের মিলনমেলায় পরিণত হয়। বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাসমূহ উক্ত সম্মেলনে উত্থাপিত হয়েছে এবং তা সমাধানের গ্রহণযোগ্য উপায়গুলো সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে। কর্ম অধিবেশনের সুপারিশ, পর্যবেক্ষণ এবং প্রস্তাব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
তীব্র অবকাঠামোগত সমস্যা ও নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটগণ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দ্রুত ও গুণগত বিচার নিষ্পত্তি নিশ্চিত করার ফলে বিচার বিভাগের উপর জনগণের আস্থা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ৪২টি জেলায় ম্যাজিস্ট্রেসি বিল্ডিং নির্মাণের প্রকল্প গৃহীত হয়েছে। ইতোমধ্যে ১২টি জেলায় নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আশা করছি আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে আরো ১৭/১৮টি ভবনের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হবে। এতে আদালতের বিদ্যমান অবকাঠামোগত সমস্যা কিছুটা লাঘব হবে। তবে এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, সমন্বয়হীনতার জন্য ম্যাজিস্ট্রেসি ভবন নির্মাণ কাজের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।
বিচার-সংক্রান্ত বস্তু ও ঐতিহাসিক স্মারকসমূহ সংগ্রহ করে প্রদর্শনের নিমিত্ত সুপ্রিম কোর্টে একটি জাদুঘর ও আর্কাইভ থাকা একান্তভাবে আবশ্যক। কিন্তু দুঃখের বিষয় স্থান সংকুলানের অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। সুপ্রিম কোর্টে বিচারকদের কোর্ট ও চেম্বার সংকট রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে কোনো প্রশাসনিক ভবন নাই।
সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের শিশুদের পরিচর্যার জন্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ডে কেয়ার সেন্টার এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট মেডিক্যাল সেন্টারের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার তীব্র সংকট রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নিরাপত্তায় ৬২৫ জনবল বিশিষ্ট “সুপ্রিম কোর্ট পুলিশ ব্যাটেলিয়ন” গঠিত হয়েছে। উক্ত ব্যাটেলিয়নের জন্য কোনো স্থান সংকুলান নাই। ফলে সুপ্রিম কোর্টের নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে এবং যেকোনো সময় অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটতে পারে। প্রয়োজনীয় স্থানাভাবে স্বল্প পরিসরে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টে লিগ্যাল এইড পাওয়ার জন্য ৫০০ জন আবেদন করেছেন। তার মধ্যে ৪৩৭ জনের আবেদন বিবেচনা করা হয়েছে। লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে ২১৯টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।
অপরাধী যত বড় হোক না কেন সে দায়মুক্তি পাবে না। চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলা প্রভাবশালী আসামী র্যাবের কতিপয় কর্মকর্তা with attitude of impunity লোমহর্ষ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, যা সমগ্র জাতিকে স্তম্ভিত করেছে। সুপ্রিম কোর্টের সময়োপযোগী হস্তক্ষেপের ফলে অপরাধীদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করা হয়। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে উক্ত মামলার বিচার নিষ্পত্তি করায় দেশের আপামর জনগণের আস্থা বিচার বিভাগের প্রতি আরো বেড়েছে।
সুষ্ঠু ও দ্রুত বিচার নিষ্পত্তির জন্য প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের প্রতিবেশী দেশসহ পৃথিবীর সকল দেশে বিচারক ও বিচার প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে আধুনিক প্রশিক্ষণ, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ দেয়ার জন্য National Judicial Academy প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এতে Forensic Laboratory, DNA Laboratory, Cyber Crime Detecting Method, Digital Evidence Recording System, IT Based Case Management সুবিধা রয়েছে। আমাদের দেশের উচ্চ আদালতের বিচারকদের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের কয়েকজন বিচারপতি ভারতের ভূপালে অবস্থিত National Judicial Academy তে স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। এ প্রশিক্ষণ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের জানার পরিধিকে আরো বিস্ততৃ করেছে মর্মে তারা অভিমত ব্যক্ত করেন। একটি পূর্ণাঙ্গ ও আধুনিক মধ্যম মানের National Judicial Academy স্থাপন করার জন্য কমপক্ষে ২৫ একর জমি বরাদ্দের জন্য সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে। আশা করি সরকার এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন আদালতে ৩০ লক্ষাধিক মামলা শুনানি ও নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এ বিশাল কর্মযজ্ঞের তুলনায় কর্মশক্তি খুবই অপ্রতুল। এটা খুব সুস্পষ্ট যে, দেশের বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন মামলার অনুপাতে বিচারকের সংখ্যা অনেক কম। তা সত্ত্বেও ঝুলে থাকা মামলাগুলো অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। কারণ বিচারপ্রার্থীগণ দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করেছেন। এছাড়া আমাদের এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে, আদালতে সার্বিক কার্যক্রমও যেন একই রকম দীর্ঘসূত্রতার কবলে পড়ে না যায়। এটা বাস্তবায়ন করার চেয়ে বলা অনেক সহজ। কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জনে বিচারক এবং আইনজীবীদের যৌথ প্রচেষ্টা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। আইনজীবীরা বিচার ব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ। বিজ্ঞ আইনজীবীদের সহযোগিতা ছাড়া দ্রুত বিচার সম্ভব নয়। তবে দুঃখজনক যে, কিছু কিছু আইনজীবী অযথা মুলতবীর দরখাস্ত এবং বিবিধ কারণ উল্লেখপূর্বক অপ্রয়োজনীয় দরখাস্ত দাখিল করে। ফলে বিচারকার্য বিলম্বিত হয়। তাছাড়া সামান্য বিষয় নিয়ে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। এর ফলে মূল মামলার বিচার কার্যক্রম অস্বাভাবিকভাবে বিলম্বিত হয়। আমি আশা করবো বিজ্ঞ আইনজীবীগণ দ্রুত ন্যায় বিচার নিষ্পত্তির জন্য আদালতকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করবেন।
সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা, মিডিয়া রাষ্ট্রের চর্তুথ অঙ্গ হিসেবে অবদান রেখে আসছে। সমাজের অসঙ্গতি দূরীকরণে সংবাদপত্র এবং সমাজ বিনির্মাণে সাংবাদিক তথা গণমাধ্যমের ভূমিকা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। মানুষের তথ্য জানার অধিকার এবং গণমাধ্যমের তথ্য জানানোর গভীর দায়বদ্ধতার প্রশ্নে সামাজিক অঙ্গীকার নিয়ে সংবাদপত্র প্রতিনিয়ত অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন সাংবাদিকরা। ফলে বিচার বিভাগ ও সাংবাদিকদের মধ্যে সুসম্পর্ক অত্যাবশ্যক। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া রাষ্ট্রের চর্তুথ স্তম্ভ হিসেবে বিচার বিভাগ ও বিচারপ্রার্থী জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ইত্যাদি বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন করার গুরুদায়িত্ব পালন করে আসছে। এ কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে স্বীকার করতে হবে যে, মিডিয়া বিচার বিভাগের বিভিন্ন কার্যক্রম বিষয়ে সময়োপযোগী সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে নিরন্তর সহযোগিতা করে বিচার বিভাগের উন্নয়ন ও সংস্কারমূলক কাজ দ্রুত সম্পাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাই আমি দেশের সংবাদপত্র, সাংবাদিক, প্রিন্ট ও ইলেকট্রোনিক মিডিয়াকে বিচার বিভাগের পক্ষ থেকে জানাই আন্তরিক সাধুবাদ।
সুপ্রিম কোর্টে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে যেখানে এসে একজন বিচারপ্রার্থী মানসিকভাবে বিচার বিভাগ সম্পর্কে একটা ইতিবাচক ধারণা পোষণ করবে। প্রতিটি জেলা আদালতের পরিবেশ এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে যাতে বিচারপ্রার্থী জনগণ আদালত অঙ্গনে প্রবেশ করার সাথে সাথে বিচার ব্যবস্থার প্রতি তার বিশ্বাস এবং আস্থার মাত্রা বেড়ে যায়।
আইনের নিরন্তর সংস্কার দ্রুত বিচার নিষ্পত্তির জন্য অপরিহার্য। সে লক্ষ্যে শত বছরের অধিক পুরনো The Code of Civil Procedure, 1908; The Code of Criminal Procedure, 1898; The Evidence Act, 1872; The Transfer of Property Act, 1882; The Negotiable Instruments Act, 1881একেবারেই সেকেলে। Land Survey Tribunal, State Acquisition and Tenancy Act, 1950 এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০; দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এবং অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩-এ অনেক ত্রুটি রয়েছে। উক্ত আইনগুলোর দুর্বলতার কারণে মামলার সংখ্যা অযথা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সঙ্গত কারণে এসব আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার অপরিহার্য। আইনের খসড়া প্রণয়নের সাথে যারা জড়িত তাদের আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় সে বিষয়ে বাস্তব জ্ঞান না থাকায় অনেক আইনে অসঙ্গতি থেকে যায় এবং ত্রুটিপূর্ণ আইনের ফলে মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং বিচার বিলম্বিত হয়। সে কারণে আইন প্রণয়নের সময় বিচার বিভাগের সাথে পরামর্শ করা হলে বহু ত্রুটি-বিচ্যুতি দূরীভূত হবে বলে আমার বিশ্বাস।
রাষ্ট্রের প্রত্যেক বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য স্বতন্ত্র চাকরির বিধান রয়েছে। অধস্তন আদালতের বিচারকদের কাজের প্রকৃতি ও ধরন অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র। বিচারকদের শৃঙ্খলামূলক বিষয়ে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকলে অধস্তন আদালতের বিচারকগণের পক্ষে স্বাধীনভাবে বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সঙ্গত কারণে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক শৃঙ্খলা ও আপীল বিধিমালা প্রণয়ন করা আবশ্যক বিধায় এর খসড়া প্রণীত হয়েছে। অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ-সংক্রান্ত বিধিমালা গেজেটে প্রকাশের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে সামান্য বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও আশা করছি অচিরেই তা দূরীভূত হবে। বিচারকেরা স্বতন্ত্র আচরণ ও শৃঙ্খলা বিধিমালা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলে বিচার বিভাগ পৃথককরণের উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হবে। পূর্ণাঙ্গ আচরণ বিধি প্রণীত না হওয়া সত্ত্বেও সুপ্রিম কোর্টের নিরবচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণ, পরিদর্শন এবং মূল্যায়নের ফলে বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের অন্য কোনো বিভাগের এবং যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে অনেক বেশি সুশৃঙ্খল এবং বিচারিক দায়িত্ব পালনে সকল স্তরের বিচারকগণ proactive role play করছেন— যা আগামী দিনগুলোতে বিচার ব্যবস্থাকে আরো উচ্চমাত্রায় নিয়ে যাবে বলে আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি।
শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও গরিব-অসহায়, হতদরিদ্র বিচারপ্রার্থীসহ আপামর বিচারপ্রার্থী জনগণকে বিচার সেবা প্রদানে সকল স্তরের বিচারকগণ আরো বেশি সংবেদনশীল ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলে বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ক্রমশ বাড়বে। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ এশিয়ার একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হবে। সকলের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সরকার তথা সংশ্লিষ্ট সকলের আরো বেশি সহযোগিতা কাম্য। আগামী দিনে বিচার বিভাগ আরো সমুজ্জ্বল ও গতিশীল হবে-এ আমার হূদয়ের গভীরতম স্থান থেকে অনুরণিত নির্মল প্রত্যাশা। (সংক্ষেপিত)
[দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণের ২য় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রধান বিচারপতি গতকাল এ বাণী দেন]
Discussion about this post