সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ন্যায় বিচারের প্রতীক গ্রিক দেবী থেমিসের ভাস্কর্যটি অপসারণ করা হচ্ছে। বেশ কয়েকটি সংগঠনের দাবি ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলতে যাচ্ছে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। আসছে ঈদুল ফিতরের আগেই এটি সরিয়ে ফেলা হবে বলে সুপ্রিমকোর্ট সূত্রে জানা গেছে। তবে কোথায় স্থানান্তর করা হবে তা এখনো জানা যায়নি।
সম্প্রতি দেবী থেমিসের ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলার দাবি জানায় হেফাজতে ইসলামসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। এ দাবির সঙ্গে পরে একাত্মতা ঘোষণা করে আওয়ামী ওলামা লীগ ও জাতীয় পার্টি (জাপা)। এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলতে বা ঢেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কিনা তা বিবেচনা করতে প্রধান বিচারপতির প্রতি আহ্বান জানান। অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভায় এক অনির্ধারিত আলোচনায় জানান, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সঙ্গে এ বিষয়ে তার কথা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী জানান, সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণের ভাস্কর্যটি বর্তমান স্থান থেকে সরিয়ে ফেলতে বা তা ঢেকে দিতে প্রধান বিচারপতিকে বলা হয়। যাতে ভাস্কর্যটি ঈদগাহের মুসল্লিদের দৃষ্টিগোচর না হয়।
সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে ফোয়ারা পরিবেষ্টিত ভাস্কর্যটি স্থাপনের পর থেকে হেফাজতে ইসলামসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন ও দল এটি সরিয়ে ফেলার দাবি জানায়। এ দাবি না মানা হলে বৃহত্তর আন্দোলনেরও হুমকি দেয় তারা। গত শুক্রবার ইসলামী শাসনতন্ত্রও ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলার দাবি জানায়। ১১ এপ্রিল হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বাধীন কওমি মাদ্রাসার একদল ওলামা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় ভাস্কর্যটি দ্রুত সরিয়ে ফেলার দাবি জানান। তাদের যুক্তি ‘এটি একটি মহিলার মূর্তি, যা জাতীয় ঈদগাহের একেবারে পাশে। মুসল্লিরা ঈদগাহে নামাজ পড়ার সময় এই মহিলার মূর্তিকে পাশে রেখেই নামাজ আদায় করবেন।’ এমন যুক্তি ও দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি দেখবেন বলে তাদের আশ্বস্ত করেন। সে সময় প্রধানমন্ত্রী কওমি মাদ্রাসার নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘গ্রিক দেবী থেমিসের ভাস্কর্য সুপ্রিমকোর্টের সামনে কীভাবে এলো আমি জানি না। ভাস্কর্যটি ওখানে রাখার প্রয়োজনও নেই। ওটা দেখতেও তো ভালো লাগে না। ঈদগাহ থেকে এটা দেখা যায়। এ ব্যাপারে আমি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলব।’ গত সোমবার গণভবনে আওয়ামী লীগের এক সভায় তিনি আরও বলেন, ‘ভাস্কর্যটি সরাতে হবে কেন এটা নিয়ে চিৎকার। সরাতে হবে না কেন? তারা কি দেখছেন না গ্রিক আর এখন গ্রিক নেই। এটা অর্ধ গ্রিক, অর্ধ বঙ্গ। বঙ্গগ্রিক হয়ে গেছে। এটা কি উনাদের চোখে পড়েনি?’ সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা হলো গ্রিক গডেস অফ জাস্টিস…থেমেসিস। গ্রিক স্ট্যাচুকে শাড়ি পরিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো। সেটাই চিফ জাস্টিসকে বলেছিলাম, এই গ্রিক স্ট্যাচুতে আপনি শাড়ি পরাতে গেলেন কেন? গ্রিক স্ট্যাচুকে বিকৃত করতে হবে কেন? নিজে কত লম্বা, পাল্লাটা কত লম্বা ঠিক-ঠিকানা নাই। বানিয়ে খাড়া করে দিল। গ্রিককে এখন বাঙালি বানানো হল।’ ভাস্কর মৃণাল হকের সঙ্গেও এই বিষয়ে কথা বলেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। এ রকম ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘স্ট্যাচু আমাদের দেশে বহু আছে, থাকবে। কিন্তু হাইকোর্টের মতো জায়গায় একটা স্ট্যাচু করা হবে এটা তো হাজার হাজার বছরের পুরনো, সব দেশে তো এটা নেই। আমাদের দেশে হঠাৎই এটা বানাতে হবে কেন?’ সুপ্রিমকোর্টের সামনেই ঈদগাহ থাকার বিষয়টি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখানে অসুবিধা হলো, ঈদগাহ। সেখানে আমাদের ঈদের নামাজ হয়। ঠিক সেই সময়টা সামনে এসে পড়ে। সবার মন-মানসিকতা তো এক নয়। নামাজের সময় এটা চোখে পড়বে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেটি যাতে চোখে না পড়ে তাই আড়াল করে দেওয়া অথবা রিমুভ করা দরকার।’ এ নিয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চিফ জাস্টিসকে প্রকাশ্যে বলিনি। তার সঙ্গে যখন দেখা হয়েছে, তাকে বলেছি। এটা ঠিক হয়নি।’ শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘এটা করতে হলে চিফ জাস্টিসের সবার সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল। কোন জায়গাটায় এটা বসবে, সেটাও দেখা উচিত ছিল।’
এদিকে সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য অপসারণের নির্দেশনা চেয়ে গত ৯ এপ্রিল হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়েছে। মোহাম্মদ আরিফুর রহমান নামে এক ব্যক্তির পক্ষে জনস্বার্থে তার আইনজীবী হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট করেন। সুপ্রিমকোর্টের সামনে থেকে ‘মূর্তি’ অপসারণে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে রুল জারির আর্জি জানানো হয়েছে রিটে। ধর্ম সচিব, আইন সচিব, গণপূর্ত সচিব, সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল ও দুই রেজিস্ট্রার, গণপূর্ত বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলী এবং সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদককে রিটে বিবাদী করা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আবেদনকারীর আইনজীবী সাংবাদিকদের জানান, তিনি রিট করেছেন। আবেদনের যুক্তিতে বলা হয়, সুপ্রিমকোর্টের সামনে ‘মূর্তি’ স্থাপন সংবিধানের ১২ ও ২৩ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। ইসলাম মূর্তির উপাসনাকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে। এ ছাড়া সুপ্রিমকোর্টের পাশেই জাতীয় ঈদগাহ রয়েছে। এখানে মূর্তি স্থাপনের মাধ্যমে দেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা হয়েছে। তাই এ মূর্তির অপসারণ চাওয়া হয়েছে।
ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলার বিষয়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুল বাসেত মজুমদার বলেন, ‘গ্রিক দেবী থেমিসের ভাস্কর্য ন্যায়বিচারের প্রতীক। তবে এটি জাতীয় ঈদগাহের একেবারে পাশে হওয়ায় অনেকেই সরিয়ে ফেলার দাবি জানাচ্ছে। আমিও মনে করি এমন এক পরিস্থিতিতে এটা ওই স্থান থেকে সরিয়ে ফেললেই ভালো হয়। এটা সেখানে রাখাও জরুরি নয়।’
এ ব্যাপারে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘গ্রিক দেবী থেমিসের ভাস্কর্য ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সামনে স্থাপন করা হয়েছে। যদিও ভাস্কর্যটি সুপ্রিমকোর্টের সামনে রাখাটা বিচারের জন্য জরুরি নয়। এখন যদি ভাস্কর্য অন্যত্র সরানো হয়, তাতেও কোনো সমস্যা বলে মনে করি না।’
আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, ‘ভাস্কর্য সরানো বা না সরানোর এখতিয়ার সুপ্রিমকোর্টের।’ অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কথা বলেছেন। এখন সিদ্ধান্ত নেবে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। আমার এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য নেই।’
এদিকে ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলার বিষয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি হননি সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের কোনো কর্তাব্যক্তি।
হিরা তালুকদার/ আমাদের সময়
Discussion about this post