অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় সুপ্রিম কোর্টে মামলা নিষ্পত্তির হার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। গত নয় মাসে আপিল বিভাগে সাড়ে ৮ হাজার এবং হাইকোর্টে সাড়ে ২৩ হাজারের বেশি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপে নি¤œ আদালতের বিচারকাজেও গতি এসেছে।<br /> সুপ্রিম কোর্টের অনুমতি ব্যতিরেকে কর্মস্থল ত্যাগ না করা, তিন মাস অন্তর বিচার বিভাগীয় সম্মেলন আয়োজন, পুরনো মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিকরণ, সাক্ষ্য গ্রহণ শুরুর পর তা সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন সাক্ষ্যগ্রহণ অব্যাহত রাখা এবং বিচারকদের পূর্ণ কর্মঘণ্টা বিচারকাজে ব্যয় করার নির্দেশনা দিয়ে বেশকিছু আদেশ জারি করেন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। এসব নির্দেশনা জারির পর নি¤œ আদালতের বিচারকরা সুপ্রিম কোর্টের অনুমতিসাপেক্ষে কর্মস্থল ত্যাগ করছেন। কেউ ফ্যাক্স বার্তার মাধ্যমে আবার কেউ ফোনে যোগাযোগ করে প্রধান বিচারপতির নির্দেশনা মান্য করে চলছেন।<br /> গত ১২ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান আপিল বিভাগের বিচারক এসকে সিনহা। এর মধ্য দিয়ে দেশের ইতিহাসে এই প্রথম হিন্দু ধর্মাবলম্বী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কেউ প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। ১৭ জানুয়ারি দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন। শপথ নেয়ার পরদিন প্রধান বিচারপতির এক নম্বর এজলাসে তাকে সংবর্ধনা দেয় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ও অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়। সংবর্ধনার জবাবে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা মামলার জট কমানো, সুপ্রিম কোর্টের ছুটি হ্রাস, অধস্তন আদালত নিয়ন্ত্রণ, সিনিয়র বিচারপতিদের গুরুত্ব দিয়ে বেঞ্চ গঠনসহ বেশকিছু বিষয়ে বক্তব্য দেন। প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা ইতোমধ্যে বিভিন্ন জেলা জজ ও দায়রা এবং ম্যাজিস্ট্রেসি আদালত পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শন করেছেন মহানগর দায়রা জজ আদালত। এসব আদালত পরিদর্শনকালে প্রধান বিচারপতির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে, মামলার শুনানি মুলতবি ও তারিখ নির্ধারণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিধি-বিধান যথাযথভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে না। মামলায় একবার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হলে সকল সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন শুনানি অব্যাহত রাখার বিধান থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে কোনো যৌক্তিক কারণ ব্যতিরেকে ইচ্ছামাফিক শুনানি মুলতবি করা হয়। দীর্ঘদিনের পুরনো মামলার শুনানির তারিখ দীর্ঘ সময় রেখে নির্ধারণ করা হয় ও অপেক্ষাকৃত নতুন মামলা সংক্ষিপ্ত বিরতিতে শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয়। এজন্য মামলায় একবার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হলে (যৌক্তিক কারণে মুলতবি অপরিহার্য না হলে) সকল সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন শুনানি অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতি। এ ছাড়া তিন বছরের অধিক পুরনো মামলার সাক্ষ্যগ্রহণকালে শুনানি যৌক্তিক কারণে মুলতবি একান্ত অপরিহার্য হলে যতদূর সম্ভব সংক্ষিপ্ত বিরতিতে (কোনো ক্রমেই এক মাসের অধিক নয়) পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পুরনো মামলা শুনানির জন্য গ্রহণ ও নিষ্পত্তি করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। গত ২২ জানুয়ারি নি¤œ আদালতের বিচারকদের প্রতি চার দফা নির্দেশনা জারি করেন। এসব নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে— পূর্বানুমতি ছাড়া কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারবেন না অধস্তন আদালতের কোনো বিচারক ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা। কর্মস্থল ত্যাগ করতে হলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের নিকট থেকে তাদেরকে অনুমতি নিতে হবে। একই সঙ্গে তিন মাস অন্তর জেলা ও দায়রা জজ এবং মহানগর দায়রা জজকে বিচার বিভাগীয় সম্মেলন ও ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রতি মাসে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি সম্মেলনের আয়োজন করতে হবে।<br /> গত জুলাই মাসে নি¤œ আদালতের কার্যক্রমের ওপর নজরদারি বাড়াতে মনিটরিং কমিটি গঠন করেন প্রধান বিচারপতি। হাইকোর্টে কর্মরত বিচারকদের নিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়। পাঁচ সদস্যের এই কমিটিকে তাদের চাহিদা মোতাবেক সকল ধরনের তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করতে নি¤œ আদালতের সকল পর্যায়ের বিচারকদের নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতি। গত এপ্রিল মাসে সুপ্রিম কোর্টে স্থাপন করেন ‘অভিযোগ/পরামর্শ বাক্স’। একই মাসে জারিকৃত আরেকটি সার্কুলারে জামিন জালিয়াতি রোধে এবং স্পর্শকাতর মামলার গোপনীয়তা রক্ষায় বহিরাগত ব্যক্তিদের (উমেদার) দিয়ে কোনো ধরনের কাজ না করাতে নি¤œ আদালতের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নির্দেশ দেয়া হয়। চলতি মাসে জারি করা আরেক সার্কুলারে নি¤œ আদালতের বিচারক, আইনজীবী, আইনজীবী-সহকারীদের সার্বক্ষণিক পরিচয়পত্র প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা হয়। আদালত অঙ্গন ও আদালতের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং টাউট ও দালালদের আদালত ভবনে প্রবেশ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।</p> কোর্টের ত্রৈমাসিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত আপিল বিভাগে ১ হাজার ৬৩৪টি এবং হাইকোর্টে ৪ হাজার ৯৯৮টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে আপিল বিভাগে ১ হাজার ৭৭৬টি এবং হাইকোর্টে ৭ হাজার ১১৯টি। এ ছাড়া জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত আপিল বিভাগে ৫ হাজার ১১৯টি এবং হাইকোর্টে ১১ হাজার ৫৭৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। অর্থাত্ প্রতি তিন মাসে মামলা নিষ্পত্তির হার বৃদ্ধি পেয়েছে।<br /> সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বর্তমানে কর্মরত বিচারপতির সংখ্যা ৬। মামলা শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য রয়েছে দুটি বেঞ্চ। প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে আপিল বিভাগের চারজন বিচারকের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে এক নম্বর আদালত। আর বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহহাব মিঞার নেতৃত্বে ২ জন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে আপিল বিভাগের ২ নম্বর আদালত। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী আপিল বিভাগে বর্তমানে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১২ হাজার ৪৬২টি। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলা রয়েছে ১০ হাজার ১৩৭টি। আর ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ২ হাজার ২৬০।<br /> হাইকোর্টে কর্মরত বিচারকের সংখ্যা ৯৭ জন। বেঞ্চের সংখ্যা ৫৪টি। এর মধ্যে দ্বৈত বেঞ্চ রয়েছে ৩৫টি, একক বেঞ্চের সংখ্যা ১৮টি। একটি বৃহত্তর বেঞ্চ রয়েছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যানে হাইকোর্টে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৩১০টি। এর মধ্যে ফৌজদারি মামলা ২ লাখ ৩৫ হাজার ৯৩২টি, দেওয়ানি ৮৬ হাজার ৩৯৬টি, রিট ও আদিম মামলা রয়েছে ৬৬ হাজার ৯৮২টি।</p>
Discussion about this post