ডেস্ক রিপোর্ট: গত বছরের ২ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের একটি মামলার শুনানিতে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনের অনিয়ম নিয়ে এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘সিসি ক্যামেরা বসিয়েও অনিয়ম রুখতে পারছি না। এটা ভয়াবহ ব্যাপার।’
সেদিন একটি মামলার শুনানির সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম অভিযোগ করেন, ‘একটি মামলা আজ তিন নম্বর সিরিয়ালে থাকার কথা। কিন্তু অদৃশ্যভাবে তা ৮৯ নম্বরে গেছে। অনেকেই মামলার তালিকা ওপর-নিচ করে কোটিপতি হয়ে গেছেন।’
এরপর প্রধান বিচারপতি তাৎক্ষণিক এক আদেশে ডেপুটি রেজিস্ট্রার মেহেদী হাসানকে তলব করেন। মামলার সিরিয়াল করা নিয়ে মেহেদী হাসানের ব্যাখ্যায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ। পরদিন ৩ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অ্যাফিডেভিট শাখার সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর গণবদলির খবর পাওয়া যায়। ২৫ জনকে বদলি করা হয় অন্য শাখায়।
এসব ঘটনার জের ধরে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে মামলার সিরিয়ালসহ বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজের ক্ষেত্রে কী ধরনের অনিয়ম হয়, তা অনুসন্ধানে নামে একটি গণমাধ্যম। তাতে উঠে আসে অনিয়ম ও দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র।
মামলার রায়ের কপি, আদেশের কপি ওঠানোসহ যেকোনো কাজে আদালতের কর্মচারীদের দিতে হয় টাকা। এই লেনদেন এমন সহজাত ব্যাপার হয়ে গেছে, যেন এটাই বিধিবদ্ধ নিয়ম। কিন্তু আদালত সূত্রে জানা গেছে, এটা নিয়ম নয়, বেআইনি লেনদেন। নিয়ম হলো, কেবল রায় বা আদেশের সার্টিফাইট কপি ওঠানোর জন্য আদালতকে নির্ধারিত ফি দিতে হয়। আর অন্যান্য খরচের টাকা মামলা দায়েরের সময়ই ফি হিসেবে নিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু কিছু কর্মচারীর কারণে এই দুই ক্ষেত্রে নির্ধারিত ফির চেয়ে বেশি না দিলে সঠিক সময়ে মেলে না প্রত্যাশিত রায়ের কপি। ‘অন্যান্য’ কাজ করতে গিয়ে পদে পদে পকেট থেকে টাকা বের না হলে কাজ মিলবে না।
গত ২ ডিসেম্বরের ঘটনার পর আদালতপাড়ায় অনিয়ম-দুর্নীতি কমেছে কি না- জানতে চাইলে জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি পদক্ষেপ নিয়েছেন।’ আপিল বিভাগে মামলার বিষয়ে অনিয়ম কম হয় বলে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল।
যেসব জায়গায় অনিয়ম বেশি: ফাইলিং শাখা, আদালতের বেঞ্চ অফিসার, মামলার আদেশ লিখতে সংশ্লিষ্ট কম্পিউটার অপারেটর, বিচারপতির আরদালি (যিনি বিচারপতির চেয়ার ঠিক করে দেন), আদালতের পিয়ন (যিনি আদেশের কপি বেঞ্চ থেকে সেকশনে নিয়ে যান)। সেকশন অফিস, অতিরিক্ত রেজিস্ট্রারের অফিস, আইটি সেকশন ও ডেচপাস শাখা। এসব জায়গায় অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বেশির ভাগ কর্মচারী। টাকা ছাড়া ফাইল নড়ে না। টাকা দিলে কাজ হয় দ্রুতগ্রতিতে। না দিলে ফাইল, রায় বা আদেশের কপি পড়ে থাকে মাসের পর মাস। এ ধরনের অনেক অভিযোগের নজির আছে।
কাকে কত দিতে হয়: মামলার ধরন ও মক্কেলের আর্থিক সংগতির ওপর নির্ভর করে কর্মচারীদের এই ‘দাবির’ পরিমাণ। ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০০ কিংবা হাজার টাকা বা তারও বেশি হয় সেটা।
সরেজমিনে দেখা যায়, হাইকোর্টে একটি রিট মামলায় সিলের জন্য ২০ থেকে ১০০ টাকা দিতে হয়। টেন্ডার নম্বরের জন্যও একই রেট। কমিশনারকে দিয়ে হলফনামার জন্য দিতে হয় ১০০ থেকে ১০০০ টাকা। কমিশনারের পিয়নকে দিয়ে করতে হলে দিতে হবে ১০০-২০০ টাকা। কোর্টে মামলা জমা দেওয়ার জন্য ৫০০ থেকে ৫০০০, ক্ষেত্রবিশেষে টাকার পরিমাণ আরও বাড়াতে হয়। আদেশের কপি টাইপের জন্য দিতে হয় কমপক্ষে এক হাজার বা তার বেশি। কোনো কোনো কোর্টে আরও বেশি। এমনও কিছু বেঞ্চ আছে, যেখানে অফিসাররা ১০০০ টাকার নিচে নেন না। ক্ষেত্রবিশেষে দিতে হয় ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা। আদেশ হওয়ার পরই সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর কাছে ছুটে আসেন বিচারপতির আরদালি। তাকে দিতে হয়ে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা। তারা এটাকে বলেন বকশিস।
আদেশের কপি সাইন করানোর জন্য বিচারপতির আরদালিকে (পিওন) দিতে হয় ১০০ থেকে ৩০০ টাকা। ক্ষেত্রবিশেষে এটা ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। (আরদালি বা পিয়নকে) ২০০, কোর্ট থেকে সেকশনে পাঠাতে ১০০ টাকা। কোনো ফাইল পাওয়া যাচ্ছে না। এটি খুঁজে বের করতে দিতে হবে ৫০০ টাকা। সেকশনে আদেশ টাইপ ও সার্টিফায়েড কপির জন্য ১০০০ থেকে ৩০০০ এবং সবশেষ ডেচপাসে দিতে হয় ১০০-২০০ টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে কর্মরত একজন ক্লার্ক বলেন, মামলা করার সময় আদালতের নির্ধারিত ফি নেওয়া হয়। তারপরও মক্কেলকে অনেক টাকা খরচ করতে হয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ পিয়ন-পেশকারদের পেছনে। তিনি বলেন, মামলা ফাইলিং থেকে শুরু করে আদেশের কপি পাঠানো পর্যন্ত ৫০০০ থেকে ১০,০০০ টাকা খরচ হয় এই খাতে। কোনো মামলার তদবিরকারক এফিডেভিট শাখায় অনুপস্থিত থাকলে কমিশনারকে দিতে হয় ১০০০ টাকা। আর উপস্থিত থাকলে দিতে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।
ওই ক্লার্কের তথ্যমতে, মামলা অ্যাফিডেভিট হয়ে যাওয়ার পর কোর্টে মোশন হিসেবে জমা দিতে হয়। যদি মোশন হিসেবে সংশ্লিষ্ট মামলার আইনজীবী এটি মিস করেন তাহলে আদালতে গিয়ে বেঞ্চ অফিসারকে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা দিলে মামলার স্লিপ জমা নেন। এরপর অনেক মামলা সিরিয়ালে এগিয়ে নিতে দিতে হয় ঘুষ। সেটিও কোনো কোনো কোর্টে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা।
মামলা শুনানি করতে আইনজীবী আদালতে আসতে দেরি করেছেন, আইটেম পার করে চলে গেছেন। তখন মামলাটি আউট লিস্ট করে দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু কিছু অসাধু কর্মচারী ঘুষের বিনিময়ে মামলাটি আউট অব লিস্ট না করে আগের জায়গায় বহাল রাখেন। এ কাজটি করেন কিছু কিছু বেঞ্চ অফিসার। মামলার শুনানি শেষে আদেশ হলে সেটি সংশ্লিষ্ট জায়গায় পৌঁছাতে দিতে হয় টাকা।
মামলার দাপ্তরিক স্তরে এসব অনিয়ম-বিশৃঙ্খলার বিষয়ে কথা হয় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, অনেক সময় ফাইল আসে না দীর্ঘদিন। ফাইল পাওয়া যায় না। আমার নিজেরই একটা মামলার ফাইল দেড় বছর ধরে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক সময় কোর্টে সময়মতো ফাইল আসে না। তদবির করতে হয়। অনেক সময় ফাইল সরিয়ে রাখেন কিছু কিছু কর্মচারী। প্রতিদিন কোনো না কোনো কোর্টে এসব অভিযোগ শোনা যায়।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফজলুর রহমান (এফআর) খান বলেন, আমরা ইতোমধ্যে অনেক সমস্যা ফেস করছি। অনেক সময় বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ মামলার ফাইল সরিয়ে ফেলে। বিচারপতিদের বিও সাহেবরা পয়সা না দিলে ফাইল নড়ায় না। আবার কিছু কিছু কোর্টের অফিসাররা সৎ আছেন। তারা কোনোদিন একটা টাকাও দুর্নীতি করে না। এ রকম কম। পিয়ন, জারিকারক প্রায় সবারই ব্যক্তিগত গাড়ি আছে। হাইকোর্টে আসে বাসে। কিন্তু বাইরে গাড়ি চালায়।
মামলার দাপ্তরিক কাজের বিভিন্ন স্তরে কর্মচারীদের অনৈতিক লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার সাইফুর রহমান বলেন, সুপ্রিম কোর্টে অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থাপ নেওয়া শুরু হয়েছে। প্রধান বিচারপতি মাঝেমধ্যে পরিদর্শন করেন। কেউ আমাদের কোনো দুর্নীতির বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছি। সম্প্রতি একটি অনিয়মের কারণে আপিল বিভাগের অ্যাফিডেভিট শাখার অনেককে বদলি করা হয়েছে। সূত্র: ঢাকা টাইমস
Discussion about this post