সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রির কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের পর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা এখন আর সংসদের হাতে নেই। আইনজীবীরা বলছেন, এর ফলে এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলই কার্যকর হলো। অবশ্য অতীতেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হয়েছে মাত্র তিনবার।
দেশে এ পর্যন্ত যে তিনবার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হয়েছে, তাতে একজন বিচারক বহিষ্কার হয়েছেন, আরেকজন পদত্যাগ করেছেন এবং অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় অন্যজন এখনও চাকরিতে বহাল আছেন। তারা হলেন বিচারপতি সৈয়দ শাহিদুর রহমান, বিচারপতি ফয়সল মাহমুদ ফয়জী ও বিচারপতি মিজানুর রহমান ভূঞা।
২০০৩ সালের ১ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সভাপতি ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ বিচারপতি সৈয়দ শাহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে একজন আসামিকে জামিন পাইয়ে দেওয়ার জন্য টাকা নেওয়ার অভিযোগ করেন। অভিযোগ তদন্তের জন্য তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মদ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে নির্দেশ দেন। এরপর ২০০৩ সালের ৬ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিচারপতি সৈয়দ শাহিদুর রহমানকে অপসারণ করতে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করে। ওই সুপারিশের ভিত্তিতে ২০০৪ সালের ২০ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মদ বিচারপতি সৈয়দ শাহিদুর রহমানকে অপসারণের আদেশ দেন। ওই দিনই তাকে অপসারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এই আদেশের বিরুদ্ধে বিচারপতি সৈয়দ শাহিদুর রহমান রিট করলে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ২০০৫ সালে অপসারণের আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করেন। হাইকোর্টের এই আদেশের বিরুদ্ধে ইদ্রিসুর রহমান নামের এক আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ শুনানি শেষে রাষ্ট্রপতির অপসারণের আদেশ বহাল রাখলেন।
এরপর ২০০৪ সালে গণমাধ্যমে জাল সনদের সংবাদ প্রকাশিত হলে বিচারপতি ফয়সল মাহমুদ ফয়জীর বিরুদ্ধে বিষয়টি তদন্তের দাবি জানায় তৎকালীন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি। তবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন হলে তিনি পদত্যাগ করেন।
সর্বশেষ ২০১৩ সালে নিহত ব্লগার রাজীব হায়দারকে নিয়ে তৈরি করা একটি প্রতিবেদন বিতরণের অভিযোগে বিচারপতি মিজানুর রহামন ভূঞার বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি। তবে সেই অভিযোগের কোনও সুরাহা হয়নি, তাই তিনি এখনও দায়িত্ব পালন করতে পারছেন।
সুপ্রিম জুড়িশিয়াল কাউন্সিল গঠন ও পদক্ষেপ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম বলেন, ‘অভিযোগের ভিত্তিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতিকে প্রধান করে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করলে অভিযুক্ত বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত হয়। কাউন্সিল তদন্ত করে প্রতিবেদন দিলে বহিষ্কৃত হন বিচারপতি সৈয়দ শাহিদুর রহমান। তদন্ত চলাকালীন পদত্যাগ করেন বিচারপতি ফয়সল মাহমুদ ফয়েজী। অন্য বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় চাকরিতে বহাল আছেন তিনি।’
তবে এর আগে ২০০১ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে বিচারপতি লতিফুর রহমানের বহুল আলোচিত ক্যাসেট কেলেঙ্কারির সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের গঠনের আগেই তিনি পদত্যাগ করেন।
উল্লেখ্য, সোমবার (৩ জুলাই) বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
রিটকারী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল গঠনের সময় প্রধান বিচারপতিই হন কাউন্সিলের প্রধান। সঙ্গে সিনিয়র একজন বিচারক ও অন্য একজন বিচারক অর্থাৎ তিনজন মিলে কাউন্সিল গঠন করা হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী করে বিষয়টি সংসদের হাতে নেওয়া হলে আমরা তা চ্যালেঞ্জ করি। যেহেতু এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ, তাই আমরা কথা বলেছি। তাছাড়া এটি সংবিধানের একটি মূলস্তম্ভ। এটাকে পরিবর্তন করা যায় না। হাইকোর্ট আমাদের আবেদন শুনে রায় দিলেও এর বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। ওই আপিলও খারিজ হয়েছে। ফলে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপরই ন্যস্ত থাকলো।’
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কর্মপদ্ধতি প্রসঙ্গে আইনজীবীরা জানান, কোনও বিচারপতি বা বিচারক সংবিধান লঙ্ঘন কিংবা গুরুতর অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত হলে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে দেন। এই কাউন্সিল তদন্ত করে অভিযোগ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রতিবেদন দেয়। তখন ওই বিষয়ে পদক্ষেপ নেন রাষ্ট্রপতি।
এ বিষয়ে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ৩ নম্বরে বলা হয়েছে, “একটি ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ থাকবে, যা এই অনুচ্ছেদে ‘কাউন্সিল’ বলে উল্লিখিত হবে এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ দু’জন বিচারপতি নিয়ে এই কাউন্সিল গঠিত হবে। তবে তারা যদি কোনও বিচারপতির বিষয়ে তদন্ত করেন, সেটা হবে অভিযোগের ভিত্তিতে। তাদের কাছে যদি কোনও অভিযোগ যায় তখনই কেবল তারা সেটি তদন্ত করবেন।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আনোয়ারুল ইসলাম শাহীন বলেন, ‘বিচারপতিদের যে কোনও ধরনের অসদাচরণ ও অদক্ষতার কারণে তাদের অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ছিল ১৯৭২ সালের সংবিধানে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির অধীনে নিয়ে আসা হয়। অর্থাৎ বিচারপতি অপসারণ করতে হলে যাবতীয় দায়দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করেন।’
/ বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post