বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলার সানারপাড় এলাকায় ক্ষুদ্র ব্যবসা করে কোনো রকমে দিন কাটাচ্ছেন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় চার দলীয় জোট সরকারের অন্যতম ষড়যন্ত্রের শিকার জজ মিয়া।
অসুস্থ মাকে নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে থাকার লড়াই তার।
এক সময় একটি বেসরকারি টেলিভিশন কোম্পানির গাড়ি চালক হিসেবে কাজ করলেও নিরাপত্তার কারণে তিনি এখন চলে গেছেন পরিচিত গণ্ডির বাইরে। পরিচিত, স্বজন ছাড়া কথাও বলেন না কারো সঙ্গে।
কখনো কখনো রেন্ট এ কার কোম্পানির গাড়ি চালালেও অধিকাংশ সময় রাতে মৌসুমী ফল বিক্রি করেই চলে তার টানাপোড়েনের সংসার।
জজ মিয়ার পরিচিত এক স্বজন জানান, টিভি চ্যানেলের গাড়ি চালকের চাকরি ছেড়ে আসার পর থেকে তিনি কেবল তার পরিচিত জন ছাড়া কারো সঙ্গে দেখা করেন না। সরকারের কাছে থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা না পেয়ে মুষড়ে পড়েছে তার পরিবার। একই সঙ্গে দেখা দিয়েছে নিরাপত্তাহীনতাও। ফলে দিনে বাসা থেকেও বের হন না জজ মিয়া।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বহুল আলোচিত গ্রেনেড হামলা মামলায় বিনা অপরাধে গ্রেফতার হন ‘জজ মিয়া নাটক খ্যাত’ এই দিনমজুর। সিআইডি’র সাজানো নাটকে পাল্টে যায় তার জীবন।
গ্রেনেড হামলার ঘটনাকে ভিন্ন পথে প্রবাহিত করতেই চারদলীয় জোট সরকারের পুলিশ প্রশাসন ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার গ্রাম থেকে জজ মিয়াকে গ্রেফতার করে।
তাকে গ্রেফতার করে আনার সময় তার মা জোবেদা খাতুনকে সিআইডি’র তৎকালীন বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সী আতিক ও আব্দুর রশীদ বলেছিলেন, ‘আপনার ছেলেকে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছি। তাকে ভালো চাকরি দেব, আপনারা সুখে থাকবেন’।
আসল ঘটনা ফাঁস হওয়ার পরে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। ২০০৯ সালের ২৬ জুলাই জেল থেকে ছাড়া পান জজ মিয়া। বিনা অপরাধে তার জীবন থেকে হারিয়ে যায় মূল্যবান চারটি বছর।
এর মধ্যে তার সংসারে নেমে আসে চরম অর্থকষ্ট। অর্ধাহার-অনাহারে জীবন কাটে তার বৃদ্ধা মা, এক বোন ও ভাইয়ের। জোবেদা খাতুন গ্রামের বাড়ি ছেড়ে বাঁচার তাগিদে ঢাকায় চলে আসেন। তিনি এখন মৃত্যু সজ্জায়। মাকে নিয়েই সানারপাড়ে এখন জজ মিয়ার সংসার।
বাবা আবদুর রশিদ ছোটকালেই মারা যান। চার ভাই এক বোনের মধ্যে জজ মিয়া দ্বিতীয়। বড় ভাই আলমগীর থাকেন চট্টগ্রামে। মায়ের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই।
জজ মিয়া ঢাকায় তার বাবার পুরনো ভাঙারি ব্যবসার পাশাপাশি গুলিস্তানে একটি সিডির দোকানে কাজ করতেন। মাঝে মধ্যে তিনি বাড়িতে এসে দু’এক দিন মায়ের সঙ্গে থেকে চলে যেতেন।
২০০৫ সালের ৯ জুন বাড়িতে গিয়ে বিকেলে বাড়ির সামনে রাজা মিয়ার চা দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন জজ মিয়া। গ্রামের চৌকিদার মুখলেছুর রহমান তাকে বলেন, ‘আপনার সঙ্গে কথা আছে’। জজ মিয়া তার সঙ্গে কিছু দূর গিয়ে দেখেন, সেনবাগ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) কবির দাঁড়িয়ে আছেন।
কবির তাকে বলেন, ‘আমার সঙ্গে একটু থানায় যেতে হবে’। এরপরের সবই ইতিহাস। সেইদিন গ্রেফতারের পর সিআইডি কার্যালয়ে ভয়-ভীতি দেখিয়ে শিখিয়ে দেওয়া জবানবন্দি আদায় করা হয়। শেখানো কথা না বললে ক্রসফায়ার ও পরিবারের সবাইকে মামলায় জড়ানোর ভয় দেখানো হয় তাকে।
প্রলোভন দেখানো হয়, কথামতো সাক্ষ্য দিলে মামলা শেষে তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
কিন্তু ঘটনা মোড় নেয় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর। ২০০৯ সালের ৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের ভিত্তিতে বিচারক মাসদার হোসেন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়ের করা হত্যা ও বিস্ফোরক মামলার মধ্যে বিস্ফোরক মামলার পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেন।
নির্দেশ অনুযায়ী, তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পান সিআইডি’র অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ। তদন্ত পেয়ে তিনি মামলাটিকে স্পর্শকাতর বিবেচনা করে গ্রেনেড হামলার পেছনে প্রভাবশালী কারও হাত ছিলো কি-না তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।
তার তদন্তেই বেরিয়ে আসে জজ মিয়া, সফিক, রানা এবং হাজী মুখলেসুর রহমানের মতো কিছু অচেনা চরিত্র।
তবে তার আগে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সিআইডি’র এএসপি ফজলুল কবীর এ মামলার নতুন ক্লু বের করেন এবং জজ মিয়া নাটক মঞ্চস্থ করার প্রক্রিয়ায় জড়িত ও তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার অভিযোগ এনে সিআইডি’র তত্কালীন ওই তিন তদন্ত কর্মকর্তার নামে মামলা করেন।
এরপরই আদালতে দাখিল করা হয় গ্রেনেড হামলা হামলার চার্জশিট। এতে সে সময়ের চারদলীয় জোট সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাত-উল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মতিঝিল থানায় দায়ের করা পৃথক দুইটি মামলার চার্জশিট দাখিল করে তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি।
গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্তে ২৮ জনের নাম পাওয় যায়। তবে তথ্য-প্রমাণের অভাবে চার্জশিট দেওয়া হয় ৬ জনকে বাদ দিয়ে। চার্জশিটভুক্ত ২২ জনের মধ্যে কারাগারে বন্দি ১৪ জন হলেন- জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ছোট ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, নিষিদ্ধ হরকাত-উল জিহাদ (হুজি) নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, তার ভাই মফিজুর রহমান ওরফে অভি, মাওলানা আবু তাহের, শরিফ শহিদুল ইসলাম ওরফে বিপুল, মাওলানা আবু সায়ীদ ওরফে ডাক্তার আবু জাফর, আবুল কালাম বুলবুল, জাহাঙ্গীর আলম, জুয়েল, হোসাইন আহমেদ ওরফে তামিম, মুফতি মঈন ওরফে আবু জান্দাল, আরিফ হাসান ওরফে সুমন, উজ্জ্বল ওরফে রতন। বাকি ৮ জন পলাতক রয়েছে।সুত্র বাংলানিউজ
Discussion about this post