বিডি ল নিউজঃ কত কষ্টে একজন নারী দেশের বাইরে গিয়ে কাজ করে তা তাদের জীবন কাহিনী না শুনলে কোন দিনও অনুভব করা যাবে না । গত বছর বাবাকে হজে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য এয়ার পোর্টে ছিলাম কিছুক্ষন । দেখলাম একজন নারী কাজের জন্য দেশের বাইরে যাবে বলে আত্নীয় স্বজন নিয়ে এয়ারপোর্টে এসেছে । খুব মন দিয়ে দেখছিলাম তাদের দৃশ্যগুলো । যে নারী দেশের বাইরে যাবেন তার পরনের কাপড়টি তিনি কিনেছেন যা তার জীবনে সবচেয়ে দামী কোন কাপড় বলে আমার মনে হল । নারীর যিনি স্বামী রয়েছেন তিনি রিকশা চালান বলে ধারণা হল আমার তাদের কথা শুনেই । এই দম্পতির একটি ছেলে সন্তানকে দেখছিলাম । আমার দৃষ্টিটা ছিলোই ঐ জায়গাটিতে । মা সন্তানকে আসলে কি বলে যাবে ! চোখে পানি আসে আমাদের এ পৃথিবীর অসহায়ত্বগুলো দেখে । ছেলের মা বলছিলো “বাবা হেদিন বিরানি খেতে চাইছিলা দিতে পারি নাই এবার পারবো বাবা, কয়েকটাদিন বাবার গলা জড়াইয়া ঘুমাইয়ো আমি তোমার স্বপ্নে স্বপ্নে আসতে আসতে একদিন সত্যিকারেই এসে তারপর বিরানি খাওয়াবো” !
দূর থেকে দেখে আমি চোখের পানি ফেলেছি কিন্তু কোন জবাব দেওয়ার ছিলোনা বা এমন কাজও করার ছিলোনা যে এই মা কে ছেলেটির কাছে রেখে দেই । অপরাধী হয়ে নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে সেখান থেকে চলে এসেছি ।
এই নারীর চোখে একটি স্বপ্নই খেলা করবে, এই নারী এক ভাবনাতেই বিদেশ জীবন পার করবে তা হল সন্তানকে সে বিরানি খাওয়ানোর জন্য সব ছেড়ে দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছে !গত কয়েকদিন ধরে মিডিয়াতে সৌদিতে নারী শ্রমিকের চরম দৈণ্যতার কথা শুনে আসছিলাম । যে চিত্র উঠে এসেছে তা সত্যিই ভয়ানক ও লজ্জার আমাদের জন্য ।
আজকে কালের কন্ঠের শিরোনাম চোখ আটকে যাবার মত ছিল । অনেক নারীই সৌদি আরব থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দেশে ফিরছে ! গত কিছুদিনে প্রায় প্রতিমাসে দুশ জন নারী ফিরে আসছে দেশে । এরা সবাই খুব বেশীভাবে নির্যাতিত । উদ্বেগের বিষয় হল মোটা অঙ্কের বেতনের লোভ দেখিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সির দালালরা শহর এবং গ্রামের নিরীহ নারীদের গৃহকর্মীর কাজে সৌদি আরবে পাঠায় এবং সেখানে যাওয়ার পর গৃহকর্মীর কাজ করা নারীদের উপর যৌন নির্যাতন সহ চলে সব ধরনের মানসিক ও দৈহিক নির্যাতন ।যারা ফিরে আসছেন তাদের সাথে কথা বলতে গেলে অনেকেই বলছে জীবন নিয়ে ফিরে এসেছি এটাই আল্লাহ তাআলার কাছে বড় শুকরিয়া । অনেকেই কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে। কেউ কেউ বলছে রাতে তিনজন, চারজন করেও নির্যাতনে অংশ নিতো, না খাইয়ে রাখতো আর বাইরে আসতে দিতোনা ।
এত অত্যাচারের পরও যারা চলে আসতে পেরেছে তারা না হয় জীবন ফিরে পেলো কিন্তু যারা কোনভাবেই বের হতে পারছেনা তাদের কি হবে ? গত বছরের আগের বছর একজন নারী দেশে ফিরে এসে এমন অভিযোগ করেছিলো সৌদি আরবেন বিপক্ষে । বাবা ছেলে মিলে নাকি ঐ নারীকে নির্যাতন করা হত বলে তিনি অভিযোগে বলেছিলেন । তারপর অনেক দিন কেটে গেছে সেগুলো আমরা ভুলে গেছি এখন আবার নতুন করে একই সমস্যার কথা শুনতে হচ্ছে আর এবার তা ঢালাওভাবে ।
মধ্যপ্রাচ্যে যে নারীরা কাজের জন্য যাচ্ছে বৈধভাবে তাদের হিসেব যদি সরকারের কাছে থেকে থাকে তবে তাদের সঠিক নিরাপত্তা দেওয়াও সম্ভব বলে মনে করি । বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) সূত্রে জানা গেছে, গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এই চার মাসে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে নারীকর্মী গেছে ৩৯ হাজার ৫৭৫ জন। এর মধ্যে সৌদি আরবেই গেছে ৩০ হাজার ১০২ জন, যা মোট নারীকর্মীর ৭৬ শতাংশ। (সূত্রঃ কালের কন্ঠ) । এত সংখ্যাক নারী সৌদি আরব গিয়ে কি অবস্থায় পতিত হচ্ছে বা তারা সঠিক কাজ নিয়ে দেশের বাইরে যেতে পারছে কিনা তা তা খুব নিখুত ভাবে খতিয়ে দেখার সময় এসেছে । সৌদি আরবে নারীরা গিয়ে এভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর এখনও সৌদি আরবের কোন বক্তব্য অফিসিয়ালভাবে জানানো হয়নি বা জানানোর কথা বলা হয়েছে কিনা তাও অপরিস্কার ।
সৌদি আরবে বাংলাদেশের দুতাবাসের কাছে আশা করছি এ ব্যপারে আইন অনুযায়ী সৌদি আরবের সাথে কথা বলা যেতে পারে। এভাবে একটি দেশের জনগণকে কাজের কথা বলে নিয়ে নির্যাতন করার মানে দাঁড়াচ্ছে তারা আমাদেরকে সঠিক সম্মানের জায়গায় স্থান দিতে পারছেনা । যে যে পরিবার থেকে বাঙালী নারীরা ফিরে এসেছে তাদের বিরুদ্ধে সৌদি আরব সরকার আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করুক এবং আমাদের দুতাবাস সৌদি আরবকে বিষয়টি সঠিকভাবে যাতে অবহিত করে তার জন্য অনুরোধ করছি । নির্যাতনের বিষয়টি অবশ্যই অপরাধ এবং এ অপরাধের শাস্তির ব্যপারে নিশ্চই আন্তর্জাতিক আইনও আছে । যদি সত্যিকারার্থেই কেউ নির্যাতনের শিকার হয় তবে আইনও নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে কথা বলার জন্যই । আমি আমাদের দেশের প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়, শ্রম মন্ত্রনালয় ও দুতাবাসের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষন বলছি এ ব্যপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি । প্রয়োজনে হটলাইন নম্বর চালু করে প্রতিটি নারী শ্রমিকদের বিমানে ওঠার আগেই তা দিয়ে দেয়ার পদ্ধতি চালু করা হোক । দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল করার জন্য যারা বিদেশ যেয়ে দিন রাত কষ্ট করে যাচ্ছে তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে হবে আমাদেরই । আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আইনানুগভাবে এ ব্যপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন ।
সাঈদ চৌধুরী
রসায়নবিদ
ও সদস্য, উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি
শ্রীপুর, গাজীপুর
Discussion about this post