নিজস্ব প্রতিবেদক: পাঁচ পরিকল্পনায় নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। এসময় তিনি স্বপ্নের ঢাকা গড়তে পাঁচ পরিকল্পনা তুলে ধরেন। পাঁচ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে- ঐতিহ্যের ঢাকা, সচল ঢাকা, সুন্দর ঢাকা, সুশাসিত ঢাকা ও উন্নত ঢাকা।
বুধবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন।
আসুন দেখে নেওয়া যাক তাপশের পাঁচ পরিকল্পনা:-
ঐতিহ্যের ঢাকা: ডিএসসিসির মেয়র প্রার্থী তাপস বলেন, চারশ’ বছরের পুরনো আমাদের এই ঢাকার রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্যের উজ্জ্বল ছবি, ঐতিহ্যের গভীর শেকড় ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব। পর্যটনের জন্য ঢাকা হতে পারে অপার সম্ভাবনার ক্ষেত্র। এখানে ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ অনন্য। সাংস্কৃতিক ধারায় রয়েছে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, পহেলা বৈশাখ, ঘুড়ি উৎসব, চৈত্র-সংক্রান্তিসহ অজস্র উৎসব। আমি নির্বাচিত হলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকাকে ‘ঐতিহ্য প্রাঙ্গণ’ হিসেবে গড়ে তুলবো। সবাইকে নিয়ে সমন্বিত প্রয়াসে জাদুঘর ও আর্ট গ্যালারি নির্মাণ ও প্রদর্শনীসহ নগরীর ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্থাপনা সংরক্ষণে মহাপরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ করে ঢাকাকে তার স্বীয় গৌরবে সাজিয়ে তুলে ধরবো বিশ্ব দরবারে।
সুন্দর ঢাকা: বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা- দুই নদীর অববাহিকায় পত্তন হওয়া আমাদের এই ঢাকা। এমন শহর পৃথিবীতে বিরল! ‘সুন্দর ঢাকা’ গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক উদ্যান নির্মাণ, সবুজায়ন, ছাদবাগানে উৎসাহ, পরিবেশবান্ধব স্থাপনা বৃদ্ধি, বায়ু ও শব্দ দূষণরোধসহ শরীর ও চিত্তবিনোদনের জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে খেলার মাঠ, শরীর চর্চা কেন্দ্র এবং নারী-শিশু ও প্রবীণদের জন্য হাঁটার উন্মুক্ত স্থান, আধুনিক মানের কমিউনিটি সেন্টারের ব্যবস্থা। সর্বসাধারণের সুবিধার্থে সাধারণ ও ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের ব্যবস্থা, দুস্থ-অসহায়দের কল্যাণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ হবে।
বস্তি উন্নয়নকে বিশেষ গুরুত্বারোপ করে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর অন্তর্ভুক্ত করা হবে। পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের নিবাসগুলোর নির্মাণ কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা, তাদের জন্য নতুন নিবাস নির্মাণ ও তাদের নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করা হবে।
খালগুলোর অবৈধ দখল উচ্ছেদ-খনন ও সৌন্দর্যবর্ধন। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, প্রয়োজনীয় সংখ্যক নর্দমা নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও জলাধার সংরক্ষণ এবং জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দৈনন্দিন ভিত্তিতে সড়কের ওপর থেকে আবর্জনার স্তূপ অপসারণ করা হবে। সড়ক থাকবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকাটিকে সবুজায়ন, শিশুপার্ক থিয়েটার হলসহ পরিকল্পিত সৌন্দর্যবর্ধন করা হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার পাড় ঘিরে বনায়ন, বিনোদন কেন্দ্র স্থাপনসহ ব্যাপক সৌন্দর্য বর্ধনের মাধ্যমে সুন্দর ঢাকা গড়ে তুলবো।
সচল চাকা: যানজটের কারণে রাস্তায় চলাচল হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানো ও ফিরে আসতে নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়। বিশেষ করে কর্মজীবী নারীদের বিড়ম্বনা অপরিসীম। গণপরিবহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কিছু রাস্তায় দ্রুতগতির যানবাহন, কিছু রাস্তায় ধীরগতির যানবাহন, আবার কিছু রাস্তায় শুধু মানুষের হাঁটার ব্যবস্থা করবো। নদীর পাড় থাকবে প্রশস্ত, সেখানে পায়ে হেঁটে চলা যাবে, চালানো যাবে সাইকেল, চলবে রিকশা। এছাড়া, দ্রুতগামী যানবাহনের জন্য থাকবে আলাদা পথ, থাকবে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা। রাস্তা পারাপারের সুব্যবস্থাসহ নগর ঘুরে দেখার ব্যবস্থা থাকবে। থাকবে প্রয়োজনীয় সড়ক বাতি। আর এভাবেই গড়ে তুলবো আমাদের সচল ঢাকা।
সুশাসিত চাকা: আওয়ামী লীগের এই মেয়র প্রার্থী বলেন, ঢাকায় একসময় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ছিল।মাদক, কিশোর অপরাধসহ নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়জনিত বিভিন্ন অপরাধ রোধের ব্যবস্থা ছিল। মাদক নির্মূল, জুয়া,কিশোর অপরাধসহ নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়জনিত বিভিন্ন অপরাধ রোধসহ এলাকাভিত্তিক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা কর্যকর ও সংশোধনকেন্দ্র নির্মাণ করবো। ঢাকা দক্ষিণ হবে বাংলাদেশে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রথম দুর্নীতিমুক্ত সংস্থা। বছরের ৩৬৫ দিন, সপ্তাহের ৭ দিন, ২৪ ঘণ্টা নাগরিক সেবা প্রদানের জন্য খোলা থাকবে। ব্যবসায়িক লাইসেন্স ৫ কর্মদিবসের মধ্যে প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে। গৃহকর (হোল্ডিং ট্যাক্স) বাড়ানো হবে না ।
মশকের প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস, মশক নিধনে দৈনন্দিন ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, হাসপাতাল-ডিসপেনসারি ও প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপনসহ মাতৃসদন, পরিবার পরিকল্পনা ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। শিক্ষার মানোন্নয়ন ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সংখ্যক কারিগরি-ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। হত-দরিদ্র মানুষের সন্তান-সন্ততির শিক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের শিক্ষা, বিনোদন ও চিকিৎসা সেবায় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করা হবে। অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করতে ফায়ার হাইড্রেন্ট নির্মাণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও পাড়া-মহল্লায় অগ্নি নির্বাপণ গাড়ি প্রবেশের কার্যকর পদক্ষেপসহ প্রয়োজনে নিজস্ব দমকল বাহিনী গঠন করা হবে। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখের আগেই ঢাকার উন্নয়ন ও সেবার সঙ্গে জড়িত সংস্থার কাছে তাদের বাৎসরিক কাজের চাহিদা পত্র প্রদানের জন্য আহ্বান করা হবে। করপোরেশন কোনও রাস্তা নির্মাণের পর অন্তত ৩ বছরের মধ্যে অন্য কোনও সংস্থা ওই রাস্তা খনন করতে পারবে না। আইন, বিধি ও নীতিমালা কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে ঢাকার উন্নয়ন ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে সিটি করপোরেশনের কাছে সমন্বিতভাবে দায়বদ্ধ করা হবে। সপ্তাহে এক দিন নগরবাসীর সঙ্গে তাদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
ওয়ান স্টপ সার্ভিস ডেক্স স্থাপন করা হবে।। দায়িত্ব গ্রহণের ৯০ দিনের মধ্যেই মৌলিক সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবো ইনশাআল্লাহ।
উন্নত ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত সুখী-সমৃদ্ধ উন্নত বাংলাদেশ-এর ‘রূপ কল্প ২০৪১’ বাস্তবায়নে উন্নত রাজধানী তথা উন্নত ঢাকা গড়ে তোলার কোনও বিকল্প নাই। অনেক সময় হয়তো পেরিয়ে গেছে, কিন্তু সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি। পাঁচ বছর মেয়াদি বিভিন্ন প্রকল্পসহ দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ৩০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে নগরীর উন্নতি সাধন, ইমারত নির্মাণ, ভূমি ব্যবস্থাপনা, ভূমি অধিগ্রহণ, নগর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে। নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের জনগণের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নতুন প্রকল্প গ্রহণসহ প্রত্যেকটি সড়ক ও নর্দমার উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের মান নিরূপণ করে অন্তত ১০ বছরের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা হবে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ বিবেচনায় নিয়ে জমির যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। জলবায়ু সংক্রান্ত উদ্বাস্তুদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। ছাত্র ও কর্মজীবী নারীদের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক হোস্টেল গড়ে তোলা হবে। জনগণকে প্রদেয় করপোরেশনের সব সেবা যথা- বাণিজ্য লাইসেন্স, জন্ম নিবন্ধন সনদ, প্রত্যয়নপত্র, গৃহ কর, পৌর কর, অন্যান্য করগুলো তথ্য প্রযুক্তিগত সেবার আওতায় আনা হবে। সব ক্ষেত্রে অনলাইন সুবিধা সম্প্রসারণ করা হবে। নগরবাসী ঘরে বসেই কর এবং নির্ধারিত ক্ষেত্রে ফি পরিশোধ সংক্রান্ত সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। করপোরেশন পরিচালনায় তথ্য প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনার প্রচলন করা এবং প্রতিটি ওয়ার্ডের আওতাভুক্ত করা হবে। ২৪ ঘণ্টা হেল্পলাইন এবং নাগরিক সেবা ও সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় তথ্য সমৃদ্ধ নগর অ্যাপ চালু করা হবে। সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় ই-লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা হবে। নগর ভবনে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ রেখে বিভিন্ন স্থানে সিসি ক্যামেরা ও ফ্রি ওয়াইফাই জোন স্থাপন করা হবে। সর্বোপরি সিটি করপোরেশনের কার্যপরিধির আওতায় সততা, নিষ্ঠা, দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সমন্বিত প্রয়াসে আমাদের উন্নত ঢাকা গড়ে তুলবো।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন- আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, মোজাফফর হোসেন পল্টু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, মহানগর দক্ষিণ শাখা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহাম্মদ মান্নাফী, যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ প্রমুখ।
Discussion about this post