স্বীকারোক্তি ও দোষ-স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু’: গ্রন্থ সমালোচনা
স্বীকারোক্তি ও দোষ-স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু পি.এম. সিরাজুল ইসলাম (সিরাজ প্রামাণিক) সুরভী বুক হাউস, ৪৮/১৩-এ, আর. কে. মিশন রোড, গোপীবাগ ঢাকা-১২০৩
ফৌজদারী বিচার-ব্যবস্থায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও দোষ-স্বীকারোক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ন্যায়বিচারের স্বার্থে ও আইনের শাসন নিশ্চিতকল্পে তা অর্থবহ ভূমিকা রাখে এবং আমাদের বিচারিক কার্যপদ্ধতিতে অন্যতম কার্যকর সূত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
কারণ, স্বীকারোক্তি হল মৌখিক ও দালিলীক বক্তব্য যা বিচার্য বিষয় বা প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে কোন ধারণার সূত্রপাত করে। অন্যদিকে, দোষ-স্বীকারোক্তি হল অপরাধকারী কর্তৃক স্বীয়-অপরাধ স্বীকার করে নেওয়া।
এতদসংক্রান্ত বাংলা ভাষায় রচিত তেমন কোন উল্লেখযোগ্য পুস্তকাদি না থাকলেও ‘পি.এম. সিরাজুল ইসলাম (সিরাজ প্রামাণিক)’ রচিত ‘স্বীকারোক্তি ও দোষ-স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু’ বইটি অনেকাংশে পাঠকের চাহিদা মেটাতে সক্ষম। বইটি বাজারে এনেছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সুরভী বুক হাউস, ৪৮/১৩-এ, আর. কে. মিশন রোড, গোপীবাগ, ঢাকা-১২০৩। প্রকাশকাল জানুয়ারী ২০১৮। বইটি এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায়ও প্রকাশিত হয়েছিল।
বইটির লেখক পি.এম. সিরাজুল ইসলাম এর জন্ম আশির দশকের শুরুতে কুষ্টিয়া জেলার খোকসা উপজেলায়। আইন পেশা ও সংবাদ মাধ্যমে তিনি ‘সিরাজ প্রামাণিক’ নামেই পরিচিত। পড়াশুনা করেছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি উচ্চতর গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন।
তাঁর গবেষণার বিষয় ‘Right to Life and Personal Liberty with Special Reference to Extra-judicial Killing in Bangladesh’. নিয়মিত আইন বিষয়ক কলাম লিখে চলেছেন ‘দি ডেইলী অবজারভার’সহ বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায়। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় পঁচিশটি। তিনি ২০১৫ সালে ‘জাতীয় শিশু পদক’ ও ২০১৬ সালে মানবাধিকার বিষয়ক ‘এজাহিকাফ পারফরমেন্স এ্যাওয়ার্ড ’ অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এর হাইকোর্ট বিভাগের একজন তালিকাভূক্ত আইনজীবী।
‘স্বীকারোক্তি ও দোষ-স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু’ বইটিতে লেখক আইনের সহজ পাঠ ও বাস্তব কেইস স্টাডি’র ভিত্তিতে রচনা করেছেন। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে উচ্চতর আদালতের সিদ্ধান্তকে সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন। যা আইনের ছাত্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের জন্য পাঠ ও সময়োপযোগী। বিশেষ ক্ষেত্রে ড্রাফটিং ও কনভিয়েনসিং সংযোজন করে বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন যা আইনজীবীদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক।
বইটিতে লেখক দোষ-স্বীকারোক্তি ও স্বীকারোক্তি গ্রহণে ম্যাজিস্ট্রেট যে নিয়মগুলো মেনে চলবেন তা বিশদ বর্ণনা করেছেন। জবানবন্দি ও স্বীকারোক্তির মধ্যকার গঠণমূলক পার্থক্য দেখিয়েছেন। যৌথ-স্বীকারোক্তি ও রাজ স্বাক্ষীর স্বীকৃতি বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।
আসামীর স্বীকারোক্তি গ্রহণে পুলিশের ভূমিকা ও পদ্ধতি এবং জবানবন্দি রেকর্ডকরণ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধি’র ১৬৪ ও ১৬৭ ধারার আলোকে যুক্তিসংগত কেইস রেফারেন্স উল্লেখ করেছেন যেখানে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি’র বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে।
লেখক দোষ-স্বীকারোক্তির গ্রহণযোগ্যতা ও অগ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন এবং কোন্ পরিস্থিতিতে তা দন্ডাদেশের ভিত্তি হতে সে বিষয়ে যুক্তিখন্ডন করেছেন। আর এ বিষয়গুলো-ই একজন আসামীর মানবাধিকার সংরক্ষণে যথেষ্ট হতে পারে। বইটিতে এ বিষয়গুলোই বিশদ বর্ণিত হয়েছে।
লেখক রিমান্ডে নামে পুলিশি নির্যাতনের কথা বলেছেন। অনেক সময় এই নির্যাতন-হেফাজতে আসামীর মৃত্যু সংঘটিত হয়,সেটিও এখানে আলোচিত হয়েছে। সর্বোপরি, বইটি আসামীর পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীন মানবাধিকারের একটি রক্ষাকবচ হিসেবে তৈরি হয়েছে।
তারপরও কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি লক্ষণীয়। বইটিতে অধ্যায়ভিত্তিক আলোচনা থাকলে ভাল হত। পাশাপাশি সাব-টাইটেল যোগ করে পৃষ্ঠা নম্বর উল্লেখ করলে বেশি মানানসই লাগত। কিছুক্ষেত্রে ফুটনোট উল্লেখ থাকলে যথার্থ মনে হত। বাস্তবে লেখক এখানে সাটামাটা আলোচনা করতে পছন্দ করেছেন। উল্লেখিত কেইস নম্বরগুলোর কোন তালিকা সংযোজন করেননি। সংশ্লিষ্ট কেইসগুলোর সিদ্ধান্ত ও পর্যালোচনায় ভাষাগত সরলতা প্রকাশ পেয়েছে।
এছাড়াও সংগৃহিত তথ্যগুলোর রেফারেন্স উল্লেখ করেননি, যা থাকলে পাঠকদের জন্য পাঠ্য উপযোগী হত। আশা করি পরবর্তী সংস্করণে লেখক বিষয়গুলো খেয়াল রাখবেন এবং আরো মানসম্মত করে তুলবেন। বইটির বর্ণবিন্যাস করেছেন মোঃ সিরাজ উদ্দিন। সর্বোপরি, কম্পিউটার কম্পোজ করা সাদা কাগজে মুদ্রিত বইটির গেটআপ ও বাঁধাই চমৎকার। সে তুলনায় বর্তমান বাজারে ৪০০ (চারশত) টাকা মূল্য সহনীয় পর্যায়েই রয়েছে।
‘স্বীকারোক্তি ও দোষ-স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু’ বইটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এটি একটি তথ্য ও মামলাবহুল পুস্তক। এতে প্রায় শতাধিক মামলার সিদ্ধান্ত আলোচিত হয়েছে। আইনের ছাত্র-ছাত্রী, আইনজীবী, বিচারক, পুলিশ ও সেনা প্রশাসনের জন্য এটি সহায়ক হবে বলে আমার বিশ্বাস। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে সিরাজুল ইসলাম’কে যিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও দেশ, কাল, সমাজ সচেতন চিন্তাবিদ।
বইটির ভূমিকা লিখেছেন প্রফেসর ড. মোঃ শাহজাহান মন্ডল, সাবেক সভাপতি ও ডিন, আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি সেখানে উল্লেখ করেছেন, বইখানি দেশে আইন ও মানবাধিকার সচেতন একটি জনগোষ্ঠী সৃষ্টি করতে অবদান রাখতে পারবে।
আমি স্যারের সাথে এ ব্যাপারে একমত পোষণ করি। পরিশেষে, সাধারণ পাঠকসহ উচ্চতর স্তরের সকলেই পুস্তকটির মাধ্যমে উপকৃত হোক এবং বাংলা ভাষায় আইনগ্রন্থ রচনা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হোক এই কামনা করি। প্রয়োজনীয় একটি আইনের বিষয়ে সুন্দর একটি বই উপহার দেয়ার জন্য লেখককে আন্তরিক অভিনন্দন ও তার সার্বিক উন্নতি প্রত্যাশা করি।
লেখকঃ শাতিল আহমেদ, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
Discussion about this post