গত দু’বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান সিলেটের মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ ইফতেখার হোসেন শামীম। নিহতের ক্ষতিপূরণ চেয়ে সিলেট ক্লেইম ট্রাইব্যুনালে দু’টি মামলা করা হয়। মামলায় ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়। সিলেটে ক্লেইম ট্রাইব্যুনালে এটিই প্রথম এ ধরনের মামলা। এ মামলার এখনো কোনো সুরাহা হয়নি।
শুধু সিলেট নয়, সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পক্ষ থেকে এ রকম মামলার নজির খুব একটা নেই। দুর্ঘটনায় শেষ পর্যন্ত কোনো তদন্ত, বিচার বা ক্ষতিপূরণ মেলে না। খুব অল্প সংখ্যক ক্ষেত্রে মালিক ও আক্রান্তদের মধ্যে আপোসের নমুনা দেখা যায়। দীর্ঘ আইনি জটিলতা আর ঝামেলার কারণে আদালতের দ্বারস্থও হয় না ক্ষতির শিকার পরিবারগুলো।
আদালতের নির্দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবারকে গাড়ির মালিকের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নজির দেশে মাত্র একটিই। সেটিও এসেছে দীর্ঘ ২৪ বছরের আইনি লড়াইয়ের পর। অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘ আইনি জটিলতার সুযোগে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছেন চালক ও পরিবহন মালিকরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের কোনোভাবেই উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে চান না পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।
আইনজীবীরা বলছেন, আইন আদালতের দীর্ঘসূত্রতার কারণে কেউ আদালতে যেতে চান না। আবার মামলা পরিচালনার মতো আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ক্ষতির মধ্যেই থেকে যায়। তাই ক্ষতিপূরণ আইন যুগোপযোগী করা এখন সময়ের দাবি।
দু’দিন আগে নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে এক লাখ টাকা ও আহতদের সর্বোচ্ছ চিকিৎসা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে সরকার। ওই দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ছিলো ৩৩ জন। এটা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রীর তাৎক্ষণিক ঘোষণা। কিন্তু প্রকৃত ক্ষতিপূরণ কি পাবে নিহত এসব পরিবার? সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) দেওয়া তথ্য মতে, দেশে প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন সাধারণ নাগরিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। সে অনুযায়ী বছরে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১১ হাজার।
বিশ্বব্যাংকের হিসেবে, বাংলাদেশে বছরে ১২ হাজার আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় সড়ক দুর্ঘটনায়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় এ সংখ্যা আরও বেশি। দেশে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কোনো মামলার প্রথম রায় আসে এ বছরের ২০ জুলাই। ২৪ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত এক সাংবাদিকের পরিবারকে ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে গাড়ির মালিককে। এ রায়কে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এতে দেখা গেছে, চালকের অবহেলার কারণে কোনো লোক আহত-নিহত হলে গাড়ির মালিককেই টাকা দিতে হয়। দেশে সড়ক দুর্ঘটনার যে আইন আছে তা ১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ী। কিন্তু এ আইনে কোনো ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার মামলা লড়ছেন তার নজির খুব একটা নেই।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজুর মোরশেদ বিডিলনিউজকে বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ আদালতেন দ্বারস্থ হচ্ছেন না। অনেকে আদালতে যাওয়া একটা ঝামেলা মনে করেন। আর ক্ষতিপূরণ মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণেও আদালতে যাচ্ছে না দুর্ঘটনার শিকার নিহতের পরিবার। তিনি জানান, উচ্চ আদালতে মামলা লড়তে গিয়ে সর্বোচ্চ কোর্ট ফি ৫০ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সেই পরিমাণ আর্থিক সচ্ছলতা নেই। মামলা না করার জন্য এটি একটি অন্যতম কারণ বলেও মনে করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, প্রশিক্ষিত চালক এবং সঠিক যানবাহন দুর্ঘটনা রোধের অন্যতম উপায়। আর সড়ক ব্যবস্থাপনার ত্রুটি দূর করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ‘দুর্ঘটনা ঘটে রাস্তা অথবা চালকের দোষে’ উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন করেন, দেশে প্রশিক্ষণের কয়টা জায়গা আছে আর কতজন প্রশিক্ষণ নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে? এগুলো বাস্তবায়ন না করলে দুর্ঘটনা কমার সম্ভাবনা নেই।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম বিডিলনিউজকে বলেন, দেশে সর্বোচ্চ আদালতে ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য পর্যাপ্ত আইনি ব্যবস্থা নেই। তবে নিম্ন আদালতে ক্ষতিপূরণের জন্য মামলা দায়ের করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু মামলার দীর্ঘসূত্রতা ও বিচারের সনাতনি পদ্ধতি নিম্ন আদালতে প্রতিকার পাওয়ার পথে বড় বাঁধা। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে অনিবার্যভাবে আইনকে যুগোপযোগী করা দরকার। অন্যান্য দেশে ক্ষতিপূরণের যে আইনি ব্যবস্থা আছে সেটা আমাদের দেশে অপ্রতুল।
সিলেট ক্লেইম ট্রাইব্যুনালের একমাত্র মামলাটির পরামর্শ দিয়েছিলেন জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম। বিডিলনিউজকে তিনি বলেন, এ মামলাটি ছিল সিলেটে প্রথম ক্লেইম ট্রাইব্যুনালের মামলা। ঢাকা বা দেশের অন্যান্য শহরেও এ আইনের মামলার প্রচলন নেই। তিনি উল্লেখ করে বলেন, বেশ কয়েক বছর আগে খুব সম্ভবত কুমিল্লার রামগতির প্রাক্তন সংসদ সদস্য আবদুল লতিফ এ আইনে প্রথম মামলা করেছিলেন। আইনটি যুগোপযোগী ও সংস্কার করা দরকার মন্তব্য করে এই আইনজীবী বলেন, আইনটির বাস্তবায়ন না হওয়ায় আইনজীবীরাও দ্বিধা- দ্বন্দ্বে থাকেন। তিনি জানান, ক্লেইম ট্রাইব্যুনাল জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে পরিচালিত হয়।
১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ী, সিলেটে ক্লেইম ট্রাইব্যুনালে এটিই প্রথম মামলা। ঘটনার ছয় মাসের মাথায় মামলা করতে হয়। আইনি সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ক্লেইম ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়েরের প্রচলন নেই। তিনি মনে করেন, এ দু’টি মামলা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইনি লড়াই মজবুত করবে যখন মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। তিনি জানান, এই একই আইন রয়েছে আমাদের পাশের দেশ ভারতে। কিন্তু আমাদের দেশে মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে এর প্রচলন নেই।
Discussion about this post