হতভাগ্য ৬০ জন এক যুগ ধরে কারাগারে আটক রয়েছেন। কিন্তু তাদের মামলার বিচার যেন শেষ হয় না। মিলছে না জামিনও। এর মধ্যে ৬২ বছর বয়সী হায়দার আলী ১৮ বছর ধরে রয়েছেন কারাগারে। ফরিদপুরের মো. ছানি ওরফে লিটন ৬৩৭ বার আদালতে হাজিরা দিলেও নিষ্পত্তি হচ্ছে না মামলার। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের মো. হায়দার আলী যখন কারাগারে যান তখন তার বয়স ছিল ৪৪ বছর। এখন তিনি ৬২ বছরের বৃদ্ধ। একটি হত্যা মামলায় ১৯৯৮ সালের ১০ মার্চ গ্রেপ্তার হন তিনি। মামলার বিচার শেষ না হলেও আদালতে হাজির করা হয়েছেন ৯৯ বার। কিন্তু জামিন মেলেনি। ১৩ বছর বয়সে কারাগারে যান মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের ফারুক হোসেন। ১২ বছর ধরে হাজত খাটছেন। ১৩১ বার আদালতে হাজির করা হয়েছে। পাননি জামিন। শুধু হায়দার বা ফারুকই নন তার মত আরো ২১ ব্যক্তি বিনা বিচারে কারাভোগ করছেন এক যুগ বা এরও বেশি সময় ধরে। আর দশ বছর ধরে কারাগারে আটক রয়েছেন আরো ৪০ জন। এদের মধ্যে শিশু বয়সে কারাগারে গেছেন ৫ জন। বছরের পর বছর অতিবাহিত হয়েছে কিন্তু এদের কারোর মামলাই নিষ্পত্তি হয়নি। হত্যা, ডাকাতি, ধর্ষণসহ বিভিন্ন ফৌজদারি মামলায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের ২৫টি কারাগারে এসব বন্দি রয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এইড কমিটির কাছে দেয়া কারা কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
এদিকে সাক্ষী গরহাজিরার কারনেই এসব ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না বলে জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে জানান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন আদালতের বিচারকদের সাথে আলোচনা করে জানা যায় যে, সাক্ষী হাজির না করার ফলে ফৌজদারি মামলা অযথা বিলম্ব হচ্ছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭১(২) ধারা অনুযায়ী সাক্ষী হাজির করার দায়িত্ব পুলিশের। অপরাধীদের গ্রেফতার করার চেয়ে সবচেয়ে কঠিন কাজ সৎ ও দক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রতিবেদন দাখিল এবং সাক্ষীদের আদালতে উপস্থিত নিশ্চিত করে প্রকৃত অপরাধীর সাজা নিশ্চিত করা। প্রধান বিচারপতি বলেন, আমাদের দেশে পুলিশ প্রশাসন অপরাধীদের গ্রেফতার করার ব্যাপারে যতটা পারদর্শী, কিন্তু সাক্ষী হাজির করার ক্ষেত্রে ততটা পারদর্শী নয়। সে কারণে মামলার ফলাফল প্রচণ্ডভাবে হতাশাজনক হয়। মনে রাখতে হবে এই পুরাতন মামলা আমাদের জন্য যেমন বিড়ম্বনার তেমনি বিচার প্রার্থীর কাছেও এগুলো বোঝা।
বিনা বিচারে দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটক বন্দিদের তালিকা চেয়ে সম্প্রতি দেশের সকল কারাগারে চিঠি পাঠায় সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এইড কমিটি। চিঠিতে বলা হয়, নিম্ন আদালতে বিচারের জন্য প্রস্তুত হওয়া মামলাসূমহ সাক্ষ্যগ্রহনসহ নানাবিধ কারেণ দীর্ঘ সময় ধরে অনিষ্পন্ন অবস্থায় পড়ে থাকে। ফলে কার্যত সাজা হওয়ার পূর্বেই আটক বন্দি দীর্ঘদিন ধরে কারাভোগ করছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা গেছে মামলায় যে দণ্ড হত তার চেয়েও বেশি সময় কারাভোগ করছেন বিচারাধীন বন্দিরা। ওই চিঠির প্রেক্ষিতে সারা দেশের কারাগারগুলো হতে তথ্য সংগ্রহ করে কারা কর্তৃপক্ষ পাঁচ ও দশ বছরের অধিক সময় ধরে বিনা বিচারে আটক ৪৬২ জন বন্দির একটি প্রতিবেদন কমিটির কাছে হস্তান্তর করে। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে লিগ্যাল এইড কমিটি দশ বছরের বেশি সময় ধরে বিনা বিচারে বন্দির সংখ্যা আলাদাভাবে প্রস্তুত করে।
এ প্রসঙ্গে লিগ্যাল এইড কমিটির সদস্য সচিব ও হাইকোর্টের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (প্রশাসন ও বিচার) সাব্বির ফয়েজ গণমাধ্যমকে বলেন, বিনা বিচারের বন্দিদের তালিকা পেয়েছি। ওই তালিকা যাচাই-বাছাই করে প্যানেল আইনজীবীর মাধ্যমে তাদেরকে আমরা আইনি সহায়তা দেব। ইতমধ্যে বেশ কয়েক জনকে আইনি সহায়তাও দিয়েছি।
কমিটির তালিকা অনুযায়ী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গুলশানের ইমরান ওরফে ইসমাইল মুসা (৪৫) গুলশান থানার মামলায় ২০০৩ সালের ২৫ এপ্রিল এবং ঢাকার ডেমরার কমল (৩১) সূত্রাপুর থানার মামলায় ২০০৪ সালের ২৪ জুলাই থেকে করাগারে আটক রয়েছেন। ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে এদের মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে কমলকে ৯২ ও ইমরানকে ৮১ বার আদালতে হাজির করা হয়েছে। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির উত্তর মানিকপুরের ওসমান গনি (২৮) ফটিকছড়ির থানার মামলায় ২০০৩ সালের ৮ ডিসেম্বর, কোতয়ালি থানার মামলায় রাউজানের জবুয়া পালংয়ের সত্যজিত পাল একই বছরের ১১ আগষ্ট থেকে, সাতকানিয়ায় থানার মামলায় দক্ষিণ বারদোনা বাহাদীর পাড়ার মো. নূরুল আমিন (২৩) ২০০৫ সালের ১৫ আগষ্ট এবং কোতয়ালির মামলায় ৯২ নং মোমিন রোড ঝাউতলার সুমন সেন ওরফে সুমন (৪৫) ২০০৬ সালের ৮ জানুয়ারি থেকে কারাবন্দি। এদেরকে ৮০ থেকে ৯৫ বার পর্যন্ত চট্টগ্রামের অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে হাজির করেছে কারা কর্তৃপক্ষ।
কক্সবাজার জেলা কারাগারে ২০০০ সালের ২০ অক্টোবর থেকে কক্সবাজার থানার মামলায় চৌফলদণ্ডীর মো. কালু ওরফে কালা মিয়া (৩৫), রামু থানার মামলায় ২০০১ সালের ২৭ মার্চ থেকে শরিয়তপুরের ভেদরগঞ্জের মো. ইসমাইল (৩৩), একই থানার মামলায় ওই বছরের ২৯ মার্চ থেকে কুমিল্লার দাউদকান্দির মনির (৩২), ২০০৩ সালের ১৮ এপ্রিল থেকে রামুর নূরুল ইসলাম (৩০) ২০০৫ সালের ২১ মে থেকে চকরিয়া থানার মামলায় সিকদার পাড়ার পূর্ব বড় ভেওলার আবুল কাশেম (৩০) এবং ২০০৬ সালের ১১ অক্টোবর থেকে কক্সবাজার থানার মামলায় ফরিদপুরের বোয়ালমারীর মো. ছানি ওরফে লিটন (৩২) এবং একই বছরের ১৯ অক্টোবর থেকে মায়ানমারের সুলতান আহাম্মদ টেকনাফ থানার মামলায় বন্দি। এদের মধ্যে মো. ছানিকে ৬৩৭ বার অর্থাৎ সর্বোচ্চ সংখ্যক আদালতে হাজির করা হয়েছে।
সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে ছয় জন বন্দির মধ্যে ওসমানীনগর থানার হত্যা মামলায় হবিগঞ্জের রাজু জগনাথ ২০০৩ সালের ৩ মার্চ, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের ফারুক হোসেন (২৫) ২০০৫ সালের ৯ ফেব্র“য়ারি এবং একই বছরের ২১ এপ্রিল থেকে বি-বাড়িয়ার মো. সেলিম মিয়া দক্ষিণ সুরমা থানার মামলায় কারাগারে আছেন। ফারুককে ১৩১ বার, সেলিমকে ১২২ বার এবং রাজু জগনাথকে ১১২ বার আদালতে হাজির করা হয়েছে। এরপরেও তাদের ভাগ্যে মেলেনি জামিন। এছাড়া সিলেটের কোতয়ালি থানার মামলায় বি-বাড়িয়ার সাব্বির আহম্মেদ ওরফে দুলাল (৪৫) ২০০৬ সালের ৯ মার্চ, একই বছরের ৭ মে থেকে সাইফুল আলম ওরফে বেলাল এবং ১৪ ডিসেম্বর থেকে নবীনগরের মো. দানা মিয়া (৫৫) কারাগারে আছেন।
গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে বিনা বিচারে ৬ জন বন্দির মধ্যে কাপাসিয়া থানার মামলায় মো. সানাউল্লাহকে (৩৮) ১৫৩ বার এবং কেরাণীগঞ্জ থানার মামলায় জামিল হোসেনকে (৫০) আদালতে হাজির করা হয়েছে ১৩৪। সানাউল্লাহ ২০০৫ সালের ৮ মে এবং জামিল ২০০৬ সালের ৩১ মার্চ থেকে কারাগারে আটক রয়েছেন।
কাশিমপুর-২ কারাগারে ৩ জন, সাতক্ষীরা জেলা কারাগারে ৫ জন, ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারে ৫ জন, খুলনা ও টাঙ্গাইল জেলা কারাগারে ২ জন করে, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ, পাবনা, নাটোর, লক্ষীপুর, সুনামগঞ্জ, বাগেরহাট ও পিরোজপুর জেলা ও কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে একজন করে দশ বছরের বেশি সময় ধরে বিনা বিচারে আটক রয়েছেন।
প্রসঙ্গত বিনা বিচারে এক যুগের বেশি সময় ধরে বিনা বিচারে কারাগারে আটক ব্যক্তিদের নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এসব প্রতিবেদন আমলে নিয়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি জেবিএম হাসানের ডিভিশন বেঞ্চ চার জনকে জামিনে মুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি তিন মাসের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি করতে বিচারিক আদালতকে বলা হয়েছে। সূত্র: ইত্তেফাক
Discussion about this post