লেলিয়ে দেয়া বিদেশি হিংস্র কুকুরের নখের আঘাতে ‘সেপটিক শক’ হয়ে হিমাদ্রি মজুমদার হিমুর মৃত্যু হয়েছে বলে আদালত পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে উল্লেখ করেছেন। রায়ে আদালত লেলিয়ে দেয়া সেই কুকুরগুলো তত্ত্বাবধানে রাখার জন্য চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার কিউরেটরকে নির্দেশ দিয়েছেন।
পূর্ণাঙ্গ রায় পর্যালোচনায় পাওয়া এসব তথ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলি ও অতিরিক্ত মহানগর পিপি অ্যাডভোকেট অনুপম চক্রবর্তী বাংলানিউজকে বলেন, কুকুর লেলিয়ে দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে গুরুতর আহত করার পরও হিমু ২৬দিন বেঁচে ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে কুকুরের নখের আঁচড়ে জখম হয়ে সেপটিক শকের কারণে হিমু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল বলে আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।
গত ১৪ আগস্ট চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো.নূরুল ইসলাম চাঞ্চল্যকর এই মামলার পাঁচ আসামির মৃত্যুদণ্ড দেন। ঘোষিত রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।
দণ্ডিত আসামিরা হল, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শাহ সেলিম টিপু ও তার ছেলে জুনায়েদ আহমেদ রিয়াদ, মাহবুব আলী ড্যানি, জাহিদুল ইসলাম শাওন এবং শাহাদাৎ হোসেন সাজু।
অ্যাডভোকেট অনুপম চক্রবর্তী জানান, ১৫৮ পাতার পূর্ণাঙ্গ রায়ের মধ্যে শেষ পাতায় দণ্ডাদেশের বিষয়টি উল্লেখ করে বাকিগুলো পর্যবেক্ষণ হিসেবে দিয়েছেন বিচারক।
রায় ঘোষণার পর আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো.কফিল উদ্দিন চৌধুরী প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, কুকুরের কামড়ে হিমুর মৃত্যুর বিষয়টি ময়নাতদন্তে প্রমাণ হয়নি। কোন ধরনের বিষক্রিয়ার প্রমাণও পাওয়া যায়নি। রাষ্ট্রপক্ষও সাক্ষ্যে কুকুরের কামড়ের বিষয়টি প্রমাণ করতে পারেনি।
তবে আদালত পূর্ণাঙ্গ রায়ের ১৫৪ পাতায় উল্লেখ করেছেন, প্রমাণিত হয়েছে যে ঘটনার সময় আসামি শাহ সেলিম টিপুর ফরহাদ ম্যানশনের ছাদে ভিকটিম হিমুর উপর চারটি বিদেশি হিংস্র জাতের কুকুর লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল। সহজেই অনুমেয় যে ময়নাতদন্তকালে হিমুর গলায় ও ঘাড়ের আশপাশে যেই নেইল মার্ক অব অ্যানিমেল (প্রাণীর নখের চিহ্ন) পাওয়া গেছে তা ছিল ফরহাদ ম্যানশনের ছাদে ভিকটিম হিমুর উপর লেলিয়ে দেয়া কুকুরের নখের আঘাত এবং উক্ত আঘাত হতে পরবর্তীতে ভিকটিম হিমুর Septic shock (সেপটিক শক) এর সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে দীর্ঘ চিকিৎসা নেওয়া স্বত্ত্বেও ভিকটিম হিমু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চমেকের সাবেক অধ্যাপক ডা.একিউএম সিরাজুল ইসলাম বলেন, কুকুরের নখের আঘাতে যদি ইনফেকশন হয় এবং সেটা যদি বেশি হয়ে রক্তে পৌঁছে যায় সেক্ষেত্রে সেপটিক শক হয়। এতে রোগির দীর্ঘদিন চিকিৎসা নেয়ার পরও মৃত্যু হতে পারে।
তবে পূর্ণাঙ্গ রায়ে উল্লেখ আছে, হিমুর মরদেহের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক হাবিবুর রহমান প্রতিবেদনে সেপটিক শকের কথা উল্লেখ করলেও আদালতে জেরায় নিশ্চিত না হওয়ার কথা বলেন। বিচারক হাবিবুরের এই বক্তব্যকে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের জেরার মুখে ‘মুখ ফসকে’ বলে দিয়েছেন হিসেবে ধরে নিয়েছেন।
২০১২ সালের জুন মাসে ফরহাদ ম্যানশনের ছাদ থেকে তিনটি বিদেশি কুকুর জব্দ করেন তৎকালীন পাঁচলাইশ থানার ওসি মো.আলমগীর হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম। মামলার অভিযোগপত্রও আদালতে দাখিল করেছিলেন ওসি আলমগীর হোসেন।
বর্তমানে বাঁশখালী থানায় কর্মরত ওসি আলমগীর হোসেন বলেন, তিনটি কুকুর জব্দ করার পর আদালতের নির্দেশে আমরা চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় হস্তান্তর করেছিলাম। শুনেছি একটি কুকুর মারা গেছে। বাকি দুইটি এখনও চিড়িয়াখানায় আছে।
আদালত আদেশে উল্লেখ করেছেন, অত্র মামলার জব্দকৃত আলামত কুকুর (যদি এখনও বেঁচে থাকে) চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার কিউরেটরের তত্ত্বাবধানে থাকিবে।
এলাকায় মাদক ব্যবসা ও সেবনের প্রতিবাদ করায় ২০১২ সালের ২৭ এপ্রিল নগরীর পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার ১ নম্বর সড়কে ‘ফরহাদ ম্যানশন’ নামে টিপুর বাড়ির চারতলায় হিমুকে হিংস্র কুকুর লেলিয়ে দিয়ে নিমর্মভাবে নির্যাতন করে সেখান থেকে ফেলে দেয় অভিজাত পরিবারের কয়েকজন বখাটে যুবক। গুরুতর আহত হিমু ২৬ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ২৩ মে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান। হিমু পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার ১ নম্বর সড়কের ইংরেজি মাধ্যমের সামারফিল্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের ‘এ’ লেভেলের শিক্ষার্থী ছিল। এ ঘটনায় হিমুর মামা প্রকাশ দাশ অসিত বাদি হয়ে পাঁচলাইশ থানায় পাঁচজনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছিলেন।
Discussion about this post