অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
পর পুরুষের সঙ্গে কথা বলার অপরাধে গৃহবধূকে ৮০ ঘা দোররা মারা হয়েছে। গ্রাম্য বিচারক বলেছেন, ‘গৃহবধূর নৈতিক স্থলন ঘটায় অন্যদের শেখানোর জন্য প্রকাশ্যে সাজা দিয়েছি; যাতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।’ এ ‘অপরাধে’ সংশ্লিষ্ট যুবকটিকেও একই শাস্তি দেয়া হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ‘বাঞ্ছারামপুরে তরুণীকে ১০১ দোররা মারা হয়েছে একটি হিন্দু ছেলের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠায়। এলাকাবাসীর ভাষায়, ‘মাওলানা সাহেবরা কোরআন-হাদিস ও ইসলামি শরিয়া মোতাবেক রায় দিয়েছেন।’ ‘অপরাধী’ মেয়েটিকে দোররা মারার এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তখনও দোররা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। যতটুকু জানি, পুলিশি শাস্তি প্রদানের সময় দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি জ্ঞান হারালে শাস্তি মুলতবি রেখে জ্ঞান ফিরিয়ে এনেই বাকি শাস্তি কার্যকর করা হয়। শাস্তি প্রদানের সেই মানবিক দিকটি সম্পূর্ণ অবহেলা করা হয়েছে।
ইমরান হোসেনের স্ত্রী রহিমা খাতুনকে একই গ্রামের নবাব আলী দ্বারা শ্লীলতাহানির ঘটনায় গ্রাম্য সালিশ থেকে দায়ী নবাব ও রহিমা খাতুনকে জরিমানা এবং ১০০ ঘা দোররা মারার ফতোয়া দেওয়া হয়। প্রেম করে বিয়ে করার অপরাধে ১০০ দোররা মারার সময় স্ত্রীর গর্ভে আট মাসের সন্তান মারা যায়। এরকম হাজারো ঘটনা প্রমাণ করে বাংলাদেশে ফতোয়াবাজির নামে নারী নির্যাতনের স্বরূপটি কী রকম ভয়াবহ।
সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাক্রমে দলপতি-নৃপতি-সমাজপতির হাত পেরিয়ে আধুনিক মানুষের বিচারব্যবস্থা এখন আদালতের হাতে ন্যস্ত রয়েছে। আদালতই হচ্ছে নাগরিকদের সম্পদ-সম্ভ্রম-অধিকারের সুরক্ষার নিশ্চয়তা প্রদানকারী বৈধ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তবু এ কথা সত্য যে, বিশেষত অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে হয়তো অনেকের পক্ষেই সামাজিক বা অর্থনৈতিক কারণে আদালতের সুরক্ষা চাওয়ার বা পাওয়ার সুযোগ থাকে না। সে কারন বহু বছর আগে বড় দুঃখেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘প্রতিবাদহীন শক্তের অপরাধে/ বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে। দেশে আইন-আদালত থাকা সত্ত্বেও বিচারের নামে ‘রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি’।
হিল্লা বিয়ে কি
‘মূলত হিল্লা বিয়ে বলতে বোঝায়, কোনো তালাক দেওয়ার পর তৃতীয় ব্যক্তির কাছে একটি নিয়মের মাধ্যমে বিয়ে দেওয়ার পর ওই নারীকে পুনরায় আগের স্বামীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করা। এ সম্পর্কে মুসলিম আইনে যথাযথ বিধান থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। শরিয়া নিয়মের অজুহাতে অনেক অঞ্চলেই এ সমস্যা ভয়াবহ রূপ ধারন করছে।
‘২০০১ সালে হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি বেঞ্চ থেকে ফতোয়াকে অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হয়। হিল্লা বিয়ে সম্পর্কে এই রায়ে বলা হয়, হিল্লা বিয়ের ফতোয়া হচ্ছে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ধারা নম্বর ৭ এবং বাংলাদেশ দন্ডবিধির ধারা নম্বর ৪৯৪, ৪৯৮, ৫০৮ ও ৫০৯ লংঘন করা।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭ নম্বর ধারাটি আমাদের সমাজে কতটুকু মানা হচ্ছে এবং এ সম্পর্কে সাধারণ জনগণ কতটুকুই বা জানে।
‘১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ধারা ৭-এ বলা আছে, কোনো লোক যদি তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিতে চান, তাহলে স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছে যত শিগগির সম্ভব লিখিত নোটিশ প্রদান করতে হবে এবং এর একটি কপি স্ত্রীকে দিতে হবে। নইলে তালাক কার্যকর হবে না। সুতরাং এখানে মৌখিক তালাকের অকার্যকরতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে, নোটিশ জারি হওয়ার পর ৯০ দিন অতিবাহিত না হলে তালাক কার্যকর হবে না। পূর্ণভাবে তালাক কার্যকর হওয়ার পর স্ত্রী যদি স্বামীর কাছে ফিরে যেতে চান, তবে কাবিনের মাধ্যমে যথাযথ আইনগত পদ্ধতিতে পুনরায় বিয়ে করলেই যথেষ্ট হবে। এক্ষেত্রে তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে সাময়িক বিয়ের প্রয়োজন নেই এবং তা তিন বার পর্যন্ত প্রযোজ্য হবে। তবে ১৯৬১ সালের অধ্যাদেশে হিল্লা বিয়ের কিছু সংশোধিত বিধি লিপিবদ্ধ আছে। দম্পতির মধ্যে পূর্ণাঙ্গ তালাক হয়ে যাওয়ার পর যদি উভয় পক্ষ মনে করেন তাঁরা পূর্বাবস্থায় ফিরতে ইচ্ছুক, তবে বিয়ের কাবিন মোতাবেক তৃতীয় বার পর্যন্ত পুনর্বিবাহ করা যায়। কিন্তু তৃতীয়বারের পরে হিল্লা বিয়ের প্রয়োজন হবে। ১৯৬১ সালের এই আইনের কিছু বিধান নিয়ে মতভেদও রয়েছে। কিন্তু এই আইনের একটি ধারায় বলা আছে, এ আইন দেশে বলবৎ অন্য যে কোনো আইন বা প্রথা থেকে প্রাধান্য পাবে।
ফতোয়া কি
আরবী ‘ফতোয়া’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘আইন সম্বন্ধীয় মত।’ প্রচলিত অর্থে ফতোয়া বলতে বোঝায় ইসলাম ধর্ম-সংক্রান্ত কিংবা এ ধর্মাবলম্বীদের দেওয়ানি বিষয়ে আইনগত মতামত। সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ অনুযায়ী, ধর্মীয় আইনবিশেষজ্ঞ বা ফিকাহশাস্ত্রে অগাধ জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ ফতোয়া দিতে পারেন। যাঁরা ফতোয়া দেন তাঁদের মুফতি বলা হয়। সাধারণত যেকোনো পরিস্থিতিতে যখন শরিয়ত-সম্পর্কিত অনুশাসনগুলোতে কোনো জটিল প্রশ্নের সরাসরি মীমাংসা পাওয়া যায় না, তখন মুফতিরা সাধারণত ফতোয়ার মাধ্যমে পূর্ববর্তী নজির এনে সমাধান দেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই বিভিন্ন ফতোয়া মুসলমান সমাজের প্রচলিত ধর্মীয় নিয়মেও পরিণত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ফতোয়ার এ সংজ্ঞাকে পাল্টে সাম্প্রদায়িক তুচ্ছ স্বার্থে বিব্রত করা হয়েছে, যার শিকার এখন বাংলাদেশের নিরক্ষর জনগণ। বর্তমানে যেসব ফতোয়া জারি করা হচ্ছে, তার মধ্যে দোররা মারা, পাথর ছুড়ে মারা, জুতাপেটা, মাথার চুল কেটে দেওয়া, বেঁধে পেটানো, মাটিতে অর্ধেক পুঁতে পাথর ছোড়া, হিল্লা বিয়ে দেওয়া প্রভৃতি। এসব নির্দেশ কোনো মতেই ফতোয়ার সুষ্পষ্ট সংজ্ঞাকে সমর্থন করে না। সব ঘটনা বাংলাদেশের সংবিধানের আইনের সমতা বিধান, নারী-পুরুষের সমতা বিধান, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার যেসব অনুচ্ছেদ লিপিবদ্ধ হয়েছে তা লংঘন। বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার-সম্পর্কিত যেসব বিধান আছে, এর ২৭, ২৮, ৩১,ও ৩৫ অনুচ্ছেদের সরাসরি লংঘন।
২০০১ সালে হাইকোর্ট ডিভিশনের বেঞ্চ থেকে ফতোয়াকে যে অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়, তা সাইফুল ও শাহিদা দম্পতির মৌখিক তালাক ও হিল্লা বিয়েকে কেন্দ্র করে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া হয়। এ রায়ে স্পষ্টভবে বলা হয়, এসব ফতোয়া বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম আইনসহ বিভিন্ন আইনের লংঘন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের মতামত সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা একমাত্র আদালতেরই আছে। ফতোয়াবাজির ঘটনাকে আমলে নিতে ম্যাজিষ্ট্রেট ও পুলিশের প্রতি নির্দেশ, স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা হিসেবে সব স্কুল ও মাদ্রসায় পারিবারিক আইন পাঠ বাধ্যতামূলক করা প্রভৃতি। এসব ফতোয়া বাংলাদেশের বিধিবদ্ধ ১৯৬১-এর মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭ ধারার বহির্ভূত এবং এ আইনের সুষ্পষ্ট লংঘন।
অনেক শরিয়া আইনের সঙ্গে এ বিধিবদ্ধ আইনের অসমাঞ্জস্যকে একটি নিছক ভাঁওতাবাজি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ শরিয়া অন্তর্ভূক্ত বিধানাবলী কোনোমতেই ফতোয়ার মতো নির্মমতা, নিষ্ঠুরতাকে সর্মথন দেয় না। এটি নিছক পবিত্র গ্রন্থের অপব্যাখ্যা করা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রতিটি ধর্মই শাস্তির কথা বলে কিন্তু ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার ও কৌশল হিসেবে ব্যবহার করলেই তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। ফতোয়া এখন ব্যবহৃত হচ্ছে গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও মানবাধিকারের বিরুদ্ধে। ফতোয়াবাজদের কখনোই নির্যাতনকারী, চোরাকারবারী, ঋণখেলাপীসহ উচ্চবিত্ত লোকজনের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করতে দেখা যায় না। এটাই প্রমাণ করে ফতোয়া এক ধরণের স্বেচ্ছাচারী ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজ। হাইকোর্ট বিভাগের ঐতিহাসিক রায়ের কার্যকারিতা প্রণয়ন করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। দেশের এ সংকটময় অবস্থায় সরকারের উচিত দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও মৌল চেতনা রক্ষার্থে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের মুখাপেক্ষী না থেকে এসব নৃশংসতার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থ গ্রহণ করা।
ফতোয়া সম্পর্কে মহামান্য হাইকোর্টের একটি রায়ের পূর্ন বিবরণ
‘গত ১ জানুয়ারি ২০০১, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ-এর সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীমকোর্ট-এর হাইকোর্ট বিভাগীয় বেঞ্চ এক যুগান্তকারী রায়ে ফতোয়াবাজিকে অবৈধ ঘোষণা করেছে৷ নওগাঁর এক গ্রামে (ফতোয়া জারি করে গৃহবধু সহিদাকে হিল্লা বিবাহে বাধ্য করার বিষয়ে হাইকোর্ট বিভাগ-এর অন্যতম সুয়োমটো রিট মামলায় সুপ্রীম কোর্টের মাননীয় বিচারপতি গোলাম রাব্বানী এবং বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা-এর সমন্বিত বিভাগীয় বেঞ্চ এই রায় দেয়। (রিট পিটিশন নম্বর ৫৮ঌ৭/২০০০, মহামান্য হাইকোর্ট)
রায়ের বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য অংশগুলো হলো
কেবল তিনবার ‘তালাক’ (একবারে, বা এক এক করে তিনবারে) করলেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয় না৷ এই চর্চা কোরান, হাদীস এমনকি মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ (ধারা-৭) এরও বিরোধী৷
‘স্বামী কর্তৃক বিবাহ বিচ্ছেদের এই অসাধু পন্থা এবং এর অপপ্রয়োগ নবী স্বয়ং নিজেও দৃঢ়ভাবে নিষেধ করেছেন’
লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, কেবল মাদ্রাসা অথবা এ জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে আসা ব্যক্তিদের মাঝেই ফতোয়াবাজীর প্রবণতা রয়েছে।এক্ষেত্রে সংশ্লি¬ষ্ট শিক্ষা ব্যবস্থা ও পদ্ধতিসমূহে কোনো ফাঁক থেকে যাচ্ছে কি-না, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন৷ আরও সুপারিশ করা যাচ্ছে যে, একটি সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থার পথে, মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ সকল স্কুল-মাদ্রাসায় পাঠ্য করা যেতে পারে, সকল মসজিদ সমূহের খতিবদের শুক্রবারের নামাজে এ বিষয়ে আলোকপাত করার জন্য আদেশ দেয়া।’
‘একটি দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি আরও সুপারিশ করা যাচ্ছে যে, ধর্ম চর্চার স্বাধীনতা যেন কোনোভাবেই বাংলাদেশে সংবিধান-এর অনুচ্ছেদ ৪১(১) তথা আইন, শৃঙ্খলা এবং নৈতিকতার পরিপন্থী না হয়ে পড়ে৷
হিল্লা বিয়ে আইনত দন্ডনীয় অপরাধ
‘বর্তমান বাংলাদেশে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের মাধ্যমে ‘হিল্লা’বিবাহ বলে যে বিয়ে প্রচলিত ছিল, সেটি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশে হিল্লা বিয়ে সম্পুর্ণ বেআইনি কাজ ও আইনত দন্ডনীয়। হিল্লা বিয়ের উপস্থিত অতিথিসহ কাজীর ৬ মাসের জেলের বিধান করে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খান হিল্লা বিয়ে নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত আইন করেন। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন ৭(৬) ধারা অনুযায়ী তালাকের মাধ্যমে কোন বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে, তালাক হওয়া দম্পতি আবার বিয়ে করতে চাইলে হিল্লা বিয়ে ছাড়াই পুনরায় বিয়ে করতে পারবে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক দৈনিক ‘সময়ের দিগন্ত’।
Discussion about this post