এ হত্যা মামলার অধিকতর তদন্তের কাজ চলছে প্রায় সাত বছর ধরে। এর মধ্যে বিচারে খালাস পেয়ে গেছে এ মামলার সব আসামি। হুমায়ুন কবির বালু হত্যা মামলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নিহতের পরিবার। তারা বলছেন, তদন্ত কাজ সঠিক পথে না এগোনোয় পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা। ২০০৯ সালের ২০ এপ্রিল রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলাটি অধিকতর তদন্ত শুরু হয়।
যেভাবে হত্যা করা হয় সাংবাদিক বালুকে: ২০০৪ সালের ২৭ জুন। সাংবাদিক বালু পরিবারের জন্য দিনটি অন্য আর দশটি দিনের তুলনায় ভিন্ন ছিল। হুমায়ুন কবির বালুর একমাত্র মেয়ে হুসনা মেহরুবা টুম্পা কৃতিত্বের সঙ্গে মাধ্যমিক পাস করে এইদিন। মাতৃহীন সন্তানের সাফল্যের এই আনন্দ ভাগ করে নিতে বালু ছুটে যান মায়ের কাছে। বালু তাঁর সন্তানদের নিয়ে থাকতেন খুলনা মহানগরীর শান্তিধাম মোড়ের (ইসলামপুর রোড) বাড়িতে। ওই বাড়ির নিচতলা ও দোতলায় ‘দৈনিক জন্মভূমি’ ও সান্ধ্য দৈনিক ‘রাজপথের দাবি’র কার্যালয়। তাঁর মা ও অন্য ভাইয়েরা থাকতেন ইকবালনগরে তাঁদের পুরানো বাড়িতে।
মাকে মিষ্টি খাইয়ে তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে তিনি যখন ফেরেন, তখন দুপুর ১২টার কিছু বেশি হবে। বাড়ির নিচে এসে তাঁর প্রাইভেট কারটি থামলে নেমে যায় মেয়ে টুম্পা ও ছোট ছেলে আশিক। বড় ছেলে আসিফের সঙ্গে বালু নামেন পরে। গেট দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকতেই বিকট শব্দে বোমা বিস্ফোরণ। বোমাটি সরাসরি বালুর কোমরে আঘাত হানে।
বোমার স্প্রিন্টারের আঘাতে আহত হন একটু সামনে এগিয়ে থাকা তাঁর বড় ছেলে আসিফ কবির। যিনি বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব। আসিফ কবির ওই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে লিখেছিলেন, কোনও আশঙ্কা বা সন্দেহ ছাড়াই অবসন্ন স্টেশন ওয়াগনটায় চড়ে আমরা বাড়ির সামনে এসে থেমেছিলাম। তখন তাতানো দুপুর। রাস্তায় লোকজন, গাড়ি, রিকশা কিছুই ছিল না তেমন। এ সময় হঠাৎ বোমা নিক্ষেপ করা হয় আমাদের বাবার ওপর।
পাঁচ মাস ১২ দিনের মাথায় খুলনা শহরে আরও এক সাংবাদিক নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হন। তাকে হত্যার আগেও একই বছর ১৫ জানুয়ারি খুলনা প্রেসক্লাবের অদূরে দৈনিক সংবাদ ও নিউ এজ’র সিনিয়র রিপোর্টার এবং বিবিসি বাংলার প্রতিনিধি মানিক চন্দ্র সাহাকে বোমা হামলায় হত্যা করা হয়।
হুমায়ুন কবির বালুর সংক্ষিপ্ত জীবনী: ১৯৪৭ সালের ৪ অক্টোবর মধুমতি নদীর তীরে নড়াইলের ইতনা গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সাংবাদিক হুমায়ুন কবির বালু। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার বরফা গ্রামে। বাবা ইমান উদ্দিন সরদার, মা রাবেয়া বেগম। তারা ছয় ভাই, তিন বোন। তিনি ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয়। হুমায়ুন কবির বালু খুলনা বি কে ইনস্টিটিউশন থেকে মাধ্যমিক, সরকারি আযম খান কমার্স কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৭২ সালে তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ‘জয় বাংলা’ পত্রিকাটির সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৩ সালে ‘সাপ্তাহিক জন্মভূমি’ দৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তিনি এই পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন। তিনি খুলনা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও তিনবারের নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। এছাড়াও তিনি মিড-টাউন রোটারি ক্লাবের সভাপতি, বাংলাদেশ কাউন্সিলর অব এডিটরসের সদস্য, খুলনা আঞ্চলিক সংবাদপত্র পরিষদের সভাপতি, পরিবার পরিকল্পনা সংস্থার সহ-সভাপতি এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) পরিচালক ছিলেন।
সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য হুমায়ুন কবির বালু ১৯৯৩ সালে সুজলা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী পদক, ১৯৯৪ সালে ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী পদক, ১৯৯৭ সালে সুর-ঝঙ্কার সম্মাননা এবং ২০০৯ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন।
যেভাবে আছে হত্যা মামলাটি: আদালত ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালের ২৭ জুনের হত্যার ঘটনায় খুলনা থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) মারুফ আহমেদ বাদী হয়ে দুটি মামলা দায়ের করেন। ২০০৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল সাংবাদিক বালু হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। এ রায়ে সব আসামিকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। রায়ে পুলিশের দুর্বল প্রতিবেদন দাখিলের কথা উল্লেখ করা হয়।
অন্যদিকে, ২০০৯ সালের ১৫ এপ্রিল রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এনামুল হক হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা দুটির মধ্যে ব্যাপক গরমিল থাকায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন বলে আবেদন করেন। ওই বছরের ১০ মে মূখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে শুনানি শেষে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডিতে পাঠানো হয়। এ পর্যন্ত সাত জন তদন্ত কর্মকর্তার পরিবর্তন হলেও হয়নি তদন্তে অগ্রগতি। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছেন সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. শাহাদাৎ হোসেন।
বালু পরিবারের বক্তব্য: তদন্তে দীর্ঘসূত্রিতার বিষয়ে সাংবাদিক হুমায়ুন কবির বালুর ছোট ভাই, খুলনা প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম জাহিদ হোসেন বাংলানিউজের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দুর্বল তদন্ত ও দীর্ঘসূত্রিতায় প্রকৃত খুনী, গডফাদার ও অর্থ যোগানদাতারা পার পেয়ে যাচ্ছে।
হত্যাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
বালুর মৃত্যুবার্ষিকীর কর্মসূচি: হুমায়ুন কবির বালুর একাদশতম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে খুলনা ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট ইউনিটির আয়োজনে শনিবার (২৭ জুন) একটি শোক র্যালি অনুষ্ঠিত হবে। শোক র্যালি শেষে খুলনা প্রেসক্লাব চত্বরের সাংবাদিক স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করা হবে। রোববার (২৮ জুন) সকাল ১১টায় খুলনা প্রেসক্লাবে বালু হত্যার বিচারের দাবিতে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
এছাড়াও ‘দৈনিক জন্মভূমি’, ‘দৈনিক রাজপথের দাবী’ ও সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু স্মৃতি পরিষদ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে।
Discussion about this post