ওয়ারিংটনের চেশায়ারে আদালতের বাইরে মানুষগুলো দাঁড়িয়ে আছেন সারিবদ্ধ হয়ে। কারও গলায় ঝোলানো লিভারপুলের মাফলার, কেউ সেটা দুহাত দিয়ে তুলে ধরেছেন ব্যানারের মতো। কেউ মৃদুস্বরে গাইছেন—‘ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন…।’ কারও চোখ থেকে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুকণা। এ কান্না দুঃখের, এ কান্না আনন্দেরও তো! এ কান্না প্রিয়জন হারানোর, এ কান্না সেসব প্রিয়জনের মৃত্যুর ২৭ বছর পর বিচার পাওয়ার আনন্দের। দীর্ঘদিন যে ট্র্যাজেডিকে স্রেফ দুর্ঘটনা বলে দাবি করা হচ্ছিল, সেটিকেই ‘বেআইনি হত্যা’ বলে রায় দিলেন ইংল্যান্ডের আদালত।
লিভারপুলের ইতিহাস বলুন কিংবা ইংল্যান্ডের ফুটবল ইতিহাস, অথবা গোটা বিশ্বের ফুটবল ইতিহাসেই একটা মর্মান্তিক দিন ছিল ১৯৮৯ সালের ১৫ এপ্রিল। শেফিল্ড ওয়েনেসডে ক্লাবের হিলসবরো স্টেডিয়ামে সেদিন এফএ কাপের ফাইনালে লিভারপুল-নটিংহাম ফরেস্ট ম্যাচের সময় হুড়োহুড়িতে পদপিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছিলেন ৯৬ জন লিভারপুল–সমর্থক।
দুই দলের সমর্থকদের সংঘর্ষ এড়াতে সেদিন স্টেডিয়াম নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছিল নির্দিষ্ট গ্যালারি। তবে ঐতিহ্য আর সমর্থনে বড় ক্লাব হওয়ার পরেও লিভারপুলের জন্য নির্ধারিত জায়গাটা ছিল তুলনামূলক ছোট। কিন্তু দর্শক হয়েছিল নির্ধারিত আসনসংখ্যার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। সেই দর্শকের চাপ সামলাতে না পেরে ম্যাচ শুরুর অল্প কিছুক্ষণ আগে ম্যাচের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা নির্দেশ দিলেন আরও একটি প্রবেশ পথ খুলে দিতে। কিন্তু ওই পথ দিয়ে স্টেডিয়ামের যে অংশে যাওয়া যেত, গ্যালারির ওই অংশগুলো পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল আগেই।
ধারণক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি দর্শক এমনিতেই হাঁসফাঁস করছিলেন, তার ওপর পেছনের মানুষের চাপে ভিড়ের সামনের মানুষগুলো চিড়ে-চ্যাপটা হতে থাকেন। অনেকে ঝুঁকি নিয়ে ওপরের গ্যালারিতে উঠতে চেয়েও পারেননি। সেটাও ছিল দর্শকে পরিপূর্ণ! ফলে সামনের নিরাপত্তাবেষ্টনীর সঙ্গে সেঁধিয়ে যেতে থাকেন তাঁরা। প্রবল জনস্রোত সইতে না পেরে একপর্যায়ে ভেঙে যায় নিরাপত্তাবেষ্টনীও। লাফিয়ে মাঠে পড়তে থাকেন দর্শকেরা। ম্যাচের তখন মাত্র সাত মিনিট চলছে। এই হুড়োহুড়িতে পায়ের তলায় চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন বেশির ভাগ লিভারপুল–সমর্থক।
পরে জানা গিয়েছিল, সব মিলিয়ে সংখ্যাটা ৯৬। আহত হয়েছিলেন আরও ৭৬৬ জন! দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এই দুর্ঘটনাস্থল থেকে সেদিন মাত্র ১৪ জনকে হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল! তার মানে, আয়োজকদের ব্যবস্থাপনাও ছিল যথেষ্ট অপ্রতুল। ফুটবলকে ভালোবেসে এমন মৃত্যু!
দীর্ঘদিন এটাকে দুর্ঘটনা বলা হলেও নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা এর বিচার দাবি করে আসছেন অনেক দিন ধরে। এ নিয়ে মামলাও হয় ২০১৪ সালে। অবশেষে ইংল্যান্ডের বিচার বিভাগের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ তদন্তের পর কাল সেই মামলার রায় দেওয়া হয়। নয় সদস্যের জুরিবোর্ড ৭-২ সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে বলেন, সেদিন ৯৬ জনের মৃত্যু আসলে নিছক দুর্ঘটনা নয়, এর দায় কর্তৃপক্ষের। আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেন, পুলিশের ভুলেই এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। সেদিন ম্যাচের কমান্ডিং অফিসারের সিদ্ধান্তের ভুলেই ভেঙে পড়েছিল নিরাপত্তাবেষ্টনী।
সেই দায়িত্বে অবহেলার জন্য অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনা হবে কি না এবং আনা হলে সেটা কী প্রক্রিয়ায়, তা এখন বিবেচনা করছে ইংল্যান্ডের ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিস।
পরবর্তী ধাপগুলো কী হয়, তা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। তবে আপাতত দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর ন্যায়বিচার পাওয়ার স্বস্তি নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের চোখে–মুখে। এটাকে ইংল্যান্ডের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে একটি মাইলফলক বলেও উল্লেখ করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, ‘৯৬ জন লিভারপুল–সমর্থক, যাঁরা মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তাঁরা আজ দীর্ঘদিন পর ন্যায়বিচার পেলেন। এ এক ঐতিহাসিক দিন!’ এএফপি।
Discussion about this post