সারা দেশে বিদ্যমান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলোতে তীব্র মামলাজটের সৃষ্টি হয়েছে। এ ধরনের ৫৪টি ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে দেড় লক্ষাধিক মামলা বিচারাধীন। এর সঙ্গে প্রতিদিনই যুক্ত হচ্ছে নতুন মামলা। ফলে মামলার জট কমাতে বিচারকদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। পাশাপাশি দেশের ১৮টি জেলায় বর্তমানে কোনো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নেই। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে নতুন করে ৪১টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করেছে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন।<br /> নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে দায়েরকৃত মামলার বিচার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে ও বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য এ প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুনভাবে সৃষ্ট ট্রাইব্যুনালগুলোর সহায়ক জনবলসহ ৪১টি জেলা জজের পদ সৃজনের জন্য তৈরিকৃত এ প্রস্তাব সোমবার আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বলেন, আমাদের প্রস্তাব অনুযায়ী ৪১টি ট্রাইব্যুনাল সৃষ্টি করা হলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা নিষ্পত্তির যে সময়সীমা বেঁধে দেয়া আছে সেটা পালন করা সম্ভব হবে। মামলা নিষ্পত্তির হার বেড়ে যাবে। জনগণ দ্রুত বিচার পাবে। এছাড়া নিু আদালতের মামলা ব্যবস্থাপনাও সঠিকভাবে করা সম্ভব হবে।<br /> নারী ও শিশু নির্যাতনমূলক অপরাধ কঠোর হস্তে দমনের লক্ষ্যে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটি প্রণয়ন করে সরকার। বিশেষ এ আইনের অধীনে দায়েরকৃত মামলাগুলোর বিচারের জন্য প্রতিটি জেলা সদরে একটি করে ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলা হয়েছে আইনের ২৬(১) ধারায়। প্রয়োজনে একাধিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া এ আইনের অধীনে দায়েরকৃত মামলাগুলোর বিচার ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ করার বিধান রয়েছে আইনটির ২০(৩) ধারায়। কিন্তু আইনের এ বিধান পূরণ হচ্ছে না। মামলাজটের কারণে একটি মামলার বিচার শেষ করতে বছরের পর বছর সময় লেগে যাচ্ছে।<br /> সূত্র মতে, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে বর্তমানে ১৮টি জেলায় কোনো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নেই। বাকি ৪৬টি জেলায় ৫৪টি ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। এসব ট্রাইব্যুনালের মধ্যে কিছু কিছু ট্রাইব্যুনালে মামলার জট অনেক বেশি। এসব দিক বিবেচনা করে যেসব জেলায় কোনো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নেই, সেসব জেলার মধ্যে ১২টি জেলায় ১২টি ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করেছে। এছাড়া যেসব জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে, তার মধ্যে ২২টি জেলায় নতুন করে আরও ২৯টি ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করেছে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন।<br /> <strong>২২ জেলায় আরও ২৯ ট্রাইব্যুনাল :</strong><br /> বিদ্যমান মামলার জট সহনীয় পর্যায়ে আনা ও সুষ্ঠুভাবে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য এবং পদ সৃজনে সরকারের আর্থিক সংশ্লেষ ও দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে আপাতত বিচারক ও মামলার অনুপাত ন্যূনতম ১:১৫শ হিসেবে ২২টি জেলায় ২৯টি নতুন ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে।<br /> এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় বিদ্যমান ৫টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পাশাপাশি নতুন করে আরও চারটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদ্যমান ট্রাইব্যুনালগুলোর মধ্যে ট্রাইব্যুনাল-১-এ মামলা রয়েছে ২ হাজার ৭৮৯টি, ট্রাইব্যুনাল-২-এ রয়েছে ২ হাজার ৯১৬টি, ট্রাইব্যুনাল-৩-এ রয়েছে ২ হাজার ৮১১টি, ট্রাইব্যুনাল-৪-এ মামলা রয়েছে ৩ হাজার ১১৪টি, ট্রাইব্যুনাল-৫-এ মামলা রয়েছে ১ হাজার ৮৪০টি।<br /> কিশোরগঞ্জে একটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। এ ট্রাইব্যুনালে মামলা বিচারাধীন রয়েছে ৩ হাজার ৬৮০টি। জেলাটিতে আরও একটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। জামালপুরে একটি ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। ট্রাইব্যুনালটিতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ২ হাজার ৮১৫টি। এ জেলায়ও নতুন করে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে তিনটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। জেলাটিতে নতুন করে আরও ৪টি ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে।<br /> কক্সবাজারের ১টি ট্রাইব্যুনালে ৫ হাজার ৮৫৭টি মামলা বিচারাধীন। এ জেলায় নতুন করে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কুমিল্লাতে ট্রাইব্যুনাল রয়েছে একটি। এ ট্রাইব্যুনালে ৪ হাজার ৩৬৫টি মামলা বিচারাধীন। এ জেলায়ও একটি নতুন ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। জেলাটিতে নতুন করে আরও ২টি ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ জেলায় নতুন করে আরও একটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। রংপুরে নতুন করে আরও দুটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। গাইবান্ধা জেলায় নতুন করে আরও একটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। নীলফামারী ও খুলনায় নতুন করে আরও দুটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। বাগেরহাটে নতুন করে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। যশোরে নতুন করে আরও একটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া হবিগঞ্জে নতুন করে আরও দুটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে।<br /> <strong>১৮ জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নেই :</strong><br /> দেশের ১৮টি জেলায় কোনো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নেই। এসব জেলা হচ্ছে-রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, মাগুরা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, জয়পুরহাট, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও ভোলা। এসব জেলার মধ্যে মামলার আধিক্য বিবেচনায় নিয়ে রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, মাগুরা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, খাগড়াছড়ি, লালমনিরহাট, জয়পুরহাট, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, পিরোজপুর ও ভোলা জেলায় একটি করে ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে।<br /> সুপ্রিমকোর্টের প্রস্তাবপত্রে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশের আদালতগুলোয় প্রায় ৩০ লাখ মামলা বিচারাধীন। এ সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব মামলার বিপরীতে কাজ করছেন মাত্র ১৬শ বিচারক। বর্তমানে বিচারক ও মামলার অনুপাত ১:১৮৭৫। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমীক্ষা অনুযায়ী বিচার কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের জন্য বিচারক ও মামলার অনুপাত হওয়া উচিত ১:৮০০। এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন টাইব্যুনাল বিশেষ ট্রাইব্যুনাল হওয়ায় এখানে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি হয়। এসব মামলায় সাক্ষীর সংখ্যা বেশি হয় এবং বিচার কার্যক্রম সম্পন্নে অধিক সময় প্রয়োজন হয়। সে বিবেচনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক ও মামলার অনুপাতের পার্থক্য আরও কম হওয়া উচিত।</p>
Discussion about this post