দেশের ৬৪ জেলা সদরে চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। খোদ পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিবেদনেই এ অভিযোগের কথা বলা হয়েছে।
এতে বলা হয়, ভবন নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম ও তথ্যগত অসামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত হয়েছে। এক ও অভিন্ন নকশায় ১২ তলা ভিতসহ ১০ তলা আদালত ভবন নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হলেও সাত তলা ভিতবিশিষ্ট ছয় তলা পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে। ৬টি জেলায় একই ধরনের অনিয়ম করা হয়েছে। এ ধরনের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনও নেওয়া হয়নি। অথচ ১০ তলা ভবন নির্মাণের জন্য দুই দফায় ১৭৪ শতাংশ ব্যয় বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। এমনকি দ্বিতীয় সংশোধনী একনেকে (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) অনুমোদনের সময়েও প্রকৃত সত্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আড়াল করা হয়েছে।
চট্টগ্রামসহ ছয় জেলার প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এ প্রতিবেদন প্রস্তুত করে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইন মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনের অনুলিপি পাঠানো হয়েছে। ছয় পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে ভবন নির্মাণে দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে তা খতিয়ে দেখে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রকল্পভুক্ত অন্যান্য জেলার কার্যক্রম বাস্তবায়নেও অনিয়ম আছে কি-না, খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণর্পূতমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, বিষয়টি জানতে হবে। প্রতিবেদন অনুযায়ী অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অন্যদিকে আইন মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সহকারী প্রধান মোহাম্মদ মেহেদী হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রতিবেদন অনুযায়ী অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, তথ্যগত বিভ্রান্তি রয়েছে। মন্ত্রী দেশের বাইরে আছেন। এ কারণে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বাজেট নিয়ে চলমান কার্যক্রম শেষ হলে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে শিগগিরই প্রতিবেদন বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনে প্রতিবেদন পাঠানো হবে।’
আইএমইডির প্রতিবেদন: আইএমইডির প্রতিনিধিরা গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলায় বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প পরিদর্শনে যান। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, চুক্তিতে অত্যাবশ্যকীয় কিছু উপাঙ্গ বাদ দেওয়া হয়েছে, বাস্তব কাজের পরিমাণ ও পরিমাপ হ্রাস করা হয়েছে, ইন্টারনাল স্যানিটারি ও ওয়াটার সাপ্লাই এবং ইন্টারনাল ইলেকট্রিফিকেশন কাজের জন্য উদ্দেশ্যমূলক একেবারে অপ্রতুল অর্থের প্রাক্কলন করায় বর্তমানে ব্যয় অত্যধিক বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রতীয়মান, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যক্তিস্বার্থে প্রকৃত তথ্য গোপন এবং প্রকল্প অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ নির্দেশিত অনুশাসনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ ধরনের অনিয়মের দায়ভার প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।
ছয় জেলার আদালত পরিদর্শন বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ক্ষেত্রে (টাইপ-২) ১২ তলা ভিতবিশিষ্ট ১০ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের ব্যয় প্রাক্কলন অনুমোদন করা হয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রামের মতোই ৬টি জেলায় একই অনিয়ম হয়েছে। প্রকল্পভুক্ত অন্যান্য জেলায়ও এ ধরনের অনিয়ম হয়েছে কি-না, জানা যায়নি। এ ছাড়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও পরে আর তা নবায়ন করা হয়নি, যা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইনের লঙ্ঘন।
চট্টগ্রামে ভবন নির্মাণে অসঙ্গতি: প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রামের আদালত ভবনটি পাহাড়ি ঢালু স্থানে নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে এর ভিত ও বেজমেন্ট কাঠামো বিশেষভাবে স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে ভবনের পেছনের অংশ প্রায় ৩০ ফুট নিচুতে রয়েছে। ভবনের নিরাপত্তার স্বার্থে পেছনের ঢালু অংশে রিটেনশন ওয়াল নির্মাণের প্রয়োজন থাকলেও তা নির্মাণাধীন ভবনের নকশায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ ছাড়া ভবনে যাতায়াতের জন্য কোর্ট চত্বরের অভ্যন্তরীণ রাস্তা মেরামত করা প্রয়োজন, যা প্রকল্পের আওতায় সম্পাদন করা না হলে ভবনটির কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। প্রতিবেদনে দুর্নীতি ও অনিয়মের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি ৬ দফা সুপারিশও করা হয়েছে।
এর আগে গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে আদালত ভবন নির্মাণ প্রকল্পে ধীরগতি ও অনিয়ম হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছিলেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তিনি বলেন, ‘৯ বছর অতিক্রান্ত হলেও ২১টি জেলায় ভবন নির্মাণের কাজ ধীর গতিতে চলছে। ৯টি জেলায় ভবন নির্মাণ শুরুই হয়নি। এ ছাড়া ২৫টি জেলা জজ আদালত ভবন ঊর্ধ্বমুখী সম্প্র্রসারণ কাজেও উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে বিচার বিভাগীয় কর্মকতাদের না রাখারও আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি।
গণমাধ্যমের অনুসন্ধান ও আইএমইডি প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, বিচার কাজ সহজ ও মামলাজট কমাতে ৬৪টি জেলা সদরে ৬ তলাবিশিষ্ট আদালত ভবন নির্মাণ প্রকল্পটি ২০০৯ সালে ১৫ এপ্রিল একনেকে অনুমোদিত হয়। পরে জমির দুষ্প্রাপ্যতা ও স্থানীয় বিচার প্রশাসনের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ৬ তলার পরিবর্তে ১২ তলা করে আদালত ভবন নির্মাণের জন্য প্রকল্পটির সংশোধিত ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) অনুমোদিত হয়। এতে প্রথম দফায় ৩৪ জেলায় আদালত ভবন নির্মাণ এবং ৩০ জেলায় জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ জন্য প্রকল্পের ব্যয় দ্বিতীয় দফায় আরও ১৪০ কোটি টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় ৮৭০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৩৪ জেলায় প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয়। ২০১৬ সালের ২৫ মে একনেকে তৃতীয় দফা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে জুন ২০১৮ সাল পর্যন্ত করা হয়। একই সঙ্গে প্রকল্প ব্যয় আগের চেয়ে প্রায় ২৩৫ শতাংশ বাড়িয়ে দুই হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা নির্ধারণ করে একনেক। তবে জমি অধিগ্রহণ, অর্থের অভাব, প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট জমি নিয়ে মামলাসহ বিভিন্ন কারণে নির্ধারিত সময়ে ভবন নির্মাণ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। এ জন্য তিনবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, ৬৪ জেলার মধ্যে এ পর্যন্ত টাঙ্গাইল, ঝিনাইদহ, জামালপুর, জয়পুরহাট, সিলেট, কুড়িগ্রাম, মৌলভীবাজার, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ ১৩টি জেলায় ভবন নির্মাণ শেষ হয়েছে। অন্যদিকে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, রাঙামাটি, সিরাজগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, পিরোজপুর, ভোলা, ঝালকাঠি, কুষ্টিয়া, মাগুরা, বরিশাল, ঢাকা জেলায় আদালত ভবন নির্মাণ কাজ এখন ২৫ শতাংশের কাছাকাছি। এর বাইরে ৩৫টি জেলা আদালত ভবন নির্মাণ কাজও ধীর গতিতে চলছে। বাকি চারটি জেলায় জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াধীন।
-সমকাল
Discussion about this post