অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি বা পদায়নের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ আইন মন্ত্রণালয় অনেক ক্ষেত্রেই মানছে না। আবার আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালর প্রস্তাব সুপ্রিম কোর্ট গ্রহণ করেননি। এরই জের ধরে অধস্তন আদালতের ৬৫ জন বিচারকের বদলি কয়েকক মাস ধরে আটকে আছে।<br /> এর পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট ২ নভেম্বর বিচারকদের বদলির বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে আইন মন্ত্রণালয়কে তিন দিনের সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। কিন্তু গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে সুপ্রিম কোর্টকে এ বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি।<br /> আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা যায়, গত কয়েক মাসে দেশের অধস্তন আদালতের বিভিন্ন স্তরের ৬৫ জন বিচারকের কর্মস্থল নির্ধারণবিষয়ক প্রস্তাবের জট লেগে আছে। এসব বিচারকের মধ্যে ৪৪ জনের নির্দিষ্ট কর্মস্থল উল্লেখ করে বদলির প্রস্তাব দিয়েছিল আইন মন্ত্রণালয়। কিন্তু তাঁদের মধ্যে ২১ জনের বদলির প্রস্তাব মেনে নিলেও বাকি ২৩ জনের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ গ্রহণ করেননি। এর পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আরও ২১ জন বিচারককে তাঁদের বর্তমান কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করে বদলির প্রস্তাব করেছিলেন। এই বিচারকদের অনেকেই তাঁদের বর্তমান কর্মস্থলে তিন বছর থাকার মেয়াদ অতিক্রম করেছেন। তবে আইন মন্ত্রণালয় সেই প্রস্তাবও মেনে নেয়নি এবং গতকাল পর্যন্ত কোনো বিচারক বদলি হননি।<br /> আইন মন্ত্রণালয় যে ২১ জনের নাম বাদ রেখে বদলির প্রস্তাব করেছিল, সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাঁদেরই বদলির আদেশ দেন। আইন মন্ত্রণালয়ও সেই প্রস্তাব মেনে নেয়নি এবং গতকাল পর্যন্ত কোনো বিচারক বদলি হননি।<br /> গত মঙ্গলবার এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, তিনি সুপ্রিম কোর্টের ওই চিঠির বিষয়ে অবহিত নন।<br /> বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল বাসেত মজুমদার এই সমস্যা দূর করতে বিদ্যমান দ্বৈত শাসন (প্রস্তাব সরকারের ও পরামর্শ আদালতের) বিলোপের প্রস্তাব করেন।<br /> উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলির বিষয়টি পুরোপুরি সুপ্রিম কোর্টের কাছে ন্যস্ত ছিল। চতুর্থ সংশোধনীতে এই ক্ষমতা সরকারের কাছে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। পঞ্চম সংশোধনীতে এই ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শে প্রয়োগের বিধান করা হয়। কিন্তু বাস্তবে সরকার আদালতের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে চলছিল। এরপর মাসদার হোসেন মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ মেনে নেওয়া সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়। পরে আপিল বিভাগ আরও দুটি পৃথক রায়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে বাহাত্তরের মূল ১১৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করেছেন।<br /> সূত্র জানায়, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিএ) কমিটির সর্বশেষ বৈঠকের পর ২১ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ১২টি পৃথক আদেশ জারি করেন। এর মাধ্যমে ওই বিচারকের বদলির বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়। ২ নভেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের এক চিঠিতে বলা হয়, খুলনা মহানগর দায়রা জজ আদালতসহ কয়েকটি পদে বিচার বিভাগীয় বদলি বা পদায়নের জন্য পরামর্শ প্রদান করা সত্ত্বেও সরকারি আদেশ বা জিও জারি করা হয়নি। এই পত্র পাওয়ার তিন দিনের মধ্যে হাইকোর্টের পরামর্শ অনুযায়ী জিও জারি করে তা কোর্টকে অবহিত করতে আইন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়। মন্ত্রণালয়কে আরও জানানো হয়, খুলনা মহানগর দায়রা জজ আদালতে দীর্ঘদিন নিয়মিত বিচারক না থাকায় মামলার জট বাড়ছে এবং বিচারপ্রার্থীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।<br /> আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ৪ অক্টোবর মন্ত্রণালয় ঢাকার বিশেষ জজ জালাল উদ্দিন আহাম্মদকে খুলনা মহানগর জজ হিসেবে বদলির প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট মন্ত্রণালয়ের ওই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হননি। আবার ফরিদপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. বজলুর রহমানকে খুলনার মহানগর দায়রা জজ হিসেবে বদলির পরামর্শ দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট। সেটিও কার্যকর করেনি মন্ত্রণালয়।<br /> সরকার ২০১০ সালে ৬৪টি জেলা সদরে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন নির্মাণ (প্রথম পর্যায়) সংশোধিত প্রকল্প গ্রহণ করে। ওই প্রকল্পে ধীর গতি চলছে। সুপ্রিম কোর্ট ওই প্রকল্পের প্রধান সমন্বয়ক পদে গোপালগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ মো. দলিল উদ্দিনকে প্রত্যাহার করে ওই প্রকল্পে নিয়োগের সুপারিশ করেন। কিন্তু মন্ত্রণালয় তা করেনি। ওই পদটি যুগ্ম সচিবের। কিন্তু উপসচিব (প্রশাসন) ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।<br /> এদিকে ওই ৬৫টি বদলি প্রস্তাবের মধ্যে পাঁচ মাসের বেশি পুরোনো ঘটনাও আছে। গত ৭ জুন ঢাকার অতিরিক্ত জেলা জজ মো. জুয়েল রানাকে তাঁর বর্তমান কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা জজ হিসেবে পদায়নের জন্য মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দেন সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু ওই পরামর্শ বাস্তবায়ন করেনি মন্ত্রণালয়।<br /> অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুব আলম বদলি বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতামত বাস্তবায়নে ধীরগতির বিষয়ে প্রথম আলোর কাছে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।<br /> উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্টের পক্ষে চার সদস্যের জিএ কমিটি ওই ৬৫ বিচারকের বদলির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছেন। প্রধান বিচারপতি ছাড়া ওই কমিটিতে আছেন হাইকোর্ট বিভাগের তিনজন বিচারপতি।<br /> সূত্রমতে, মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্টের প্রস্তাব বা পরামর্শ একে অপরে গ্রহণ করতে বিলম্ব বা জটিলতার কারণে যুগ্ম জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতির জন্য প্যানেলভুক্ত প্রায় ৯০ জন জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ ঝামেলা পোহাচ্ছেন। দেশে দীর্ঘদিন ধরে যুগ্ম জেলা জজের ৯০টি পদ শূন্য আছে। এ জন্য ৪১টি ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালের ৩০টি অকার্যকর রয়েছে।<br /> সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আমিনুল ইসলাম ১২ নভেম্বর এ বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তবে তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা অস্ট্রেলিয়া সফর করছেন। ১৪ নভেম্বর তিনি দেশে ফিরবেন।<br /> -মিজানুর রহমান খান, প্রথম আলো
Discussion about this post