দেশের বিভিন্ন আদালতে প্রতি বছরই ব্যাপক হারে মামলা দায়েরের ঘটনা বাড়ছে। গত ছয় বছরে দেশের আদালতসূমহে ৮৩ লাখ মামলা দায়ের হয়েছে। একই সময়ে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ৬৭ লাখ। ফলে প্রতি বছরই লাখ লাখ মামলা অনিষ্পন্ন অবস্থায় ঝুলে রয়েছে। অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি, দেওয়ানি জটিলতা এবং নতুন আইন প্রণয়ন ও ওইসব আইনের অধীনে নতুন আদালত সৃষ্টি হওয়ায় মামলার সংখ্যা বেড়েই চলেছে।</p> এর বাইরে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় গত কয়েক বছরে মামলার সংখ্যা লাখের উপর ছাড়িয়ে গেছে। গত ছয় বছরে যেখানে গড়ে মামলা দায়ের হয়েছে ১৪ লাখ সেখানে রাজনৈতিক সহিংসতার বছর (২০১৪ সাল) মামলা হয়েছে ১৬ লাখ।</p> মামলা দায়েরের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কমানো যাচ্ছে না মামলার জট। এ প্রসঙ্গে আইন কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩১ লাখ মামলার ভারে বিচার বিভাগ আজ ন্যুব্জ এবং ক্রমাগতভাবে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাত্র ১৬ শত বিচারকের পক্ষে এত মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়। সর্বশেষ, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইন ও রিভিশনাল জরিপ সংক্রান্ত ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল করার ফলে অতি অল্প সময়ে লাখ লাখ মোকদ্দমার সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি দ্রুত নিষ্পত্তিযোগ্য আরবিট্রেশন মোকদ্দমার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করতেও বছরের পর বছর লেগে যাচ্ছে। যার কারণে হ্রাস পাচ্ছে না মামলার জট। প্রতিবেদনে বলা হয়, সমগ্র আইনি কার্যবিধির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সঠিক সময়ে, সঠিক আইনগত পরামর্শ। বিরোধ শুরু হলে উভয় পক্ষের মধ্যে জেদ কাজ করে, উস্কে দেয়ার লোকেরও অভাব থাকে না। সেখানেই প্রয়োজন সঠিক আইনগত পরামর্শ। ধারণা করা যায় যে, সঠিক সময়ে সঠিক আইনগত পরামর্শ প্রদান করা হলে শতকরা ৫০-৬০ ভাগ মোকদ্দমা দায়েরই হত না। তিন-চার যুগ আগে দেখা গেছে যে আইনজীবীগণ অহেতুক ও তুচ্ছ মামলা/মোকদ্দমা করতে নিরুত্সাহিত করতেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এখন আর সে রকমটি নেই।</p> সুপ্রিম কোর্টের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, দেশের আদালতসূমহে সর্বশেষ বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩১ লাখ ৯ হাজার ১৭৩টি। এর মধ্যে ১৭ লাখ ৮৭ হাজার ২৯৫টি মামলা জেলা ও দায়রা জজ আদালতসহ সকল প্রকার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে রয়েছে ৯ লাখ ১৪ হাজার ২৯২টি। সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪ লাখ ৭ হাজার ৫৮৬টি।</p> পরিসংখ্যানে বলা হয়, গত বছর ১৫ লাখ ৪৬ হাজার ৫০২টি নতুন মামলা দায়েরের বিপরীতে নিষ্পত্তি হয়েছে ১৪ লাখ ২৬ হাজার ৬৭৬ টি মামলা। ২০১৪ সালে ১৬ লাখ ৭ হাজার ২৫৫টি মামলা দায়ের হয়েছে। নিষ্পত্তি হয়েছে ১৩ লাখ ৪ হাজার ৫৪৪টি। এর আগের বছর অর্থাত্ ২০১৩ সালে ১৫ লাখ ৫ হাজার ১৬৭টি মামলা দায়ের হয়েছে। নিষ্পত্তি হয়েছে ১১ লাখ ১৯ হাজার ২৯৪টি। একইভাবে ২০১২ সালে ১১ লাখ ৩১ হাজার ৫৫৯ টি মামলা দায়েরের বিপরীতে ১০ লাখ ৩২ হাজার ১৮৯টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। ২০১০ সালে ১২ লাখ ১৭ হাজার ৯২৭টি মামলা দায়েরের বিপরীতে নিষ্পত্তি সংখ্যা ১১ লাখ ১ হাজার ৫৩৩টি। একইভাবে ২০০৯ সালে ১০ লাখ ২৭ হাজার ১৩১ মামলার বিপরীতে ৭ লাখ ৩১ হাজার ৫৪২টি মামলা নিষ্পত্তি করেছে দেশের আদালতগুলো। ওই বছরের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত আদালতগুলোতে বিচারাধীন ছিল ১৭ লাখ ৭৭ হাজার ৮৯৮টি মামলা। মামলা নিষ্পত্তির বিপরীতে প্রতি বছরই দুই থেকে তিন লাখ মামলা বেশি দায়ের হওয়ায় এই জট ক্রমাগতভাবেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।</p> দেশের আদালতসূমহে মামলা জট বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধান করেছে আইন কমিশন। কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত শতকের আশির দশকের প্রথম হতে অনেক নতুন নতুন আইনের আওতায় নানা ধরনের আদালত সৃষ্টি করা হয়। সেই সকল নতুন আদালতের দায়িত্ব বিদ্যমান বিচারকগণকেই তাদের পূর্বের বিচারিক কাজের অতিরিক্ত হিসেবে পালন করতে হয়। ফলে বিচার কাজের এই বাড়তি চাপ সামাল দেয়া সম্ভব হয় না। ফলে একদিকে স্তূপীকৃত মামলার পরিমাণ বাড়তে থাকে, অন্যদিকে একই বিচারককে বিভিন্ন ধরনের মামলা নিষ্পত্তি করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই ন্যায় বিচার ব্যাহত হতে থাকে। কমতে থাকে বিচার বিভাগের উপর সাধারণ জনগণের আস্থা। বাড়তে থাকে আপিল ও রিভিশনের সংখ্যাও। এভাবে ধীরে ধীরে বিভিন্ন ধরনের মামলার সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। যার প্রভাব উচ্চ আদালতেও পড়েছে।</p> জানা গেছে, ২০০১ সালের অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনে ২০১১ সালে সংশোধনী আনে সরকার। ওই সংশোধনীর পর গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ধরনের মোকদ্দমার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৯ হাজার ৮৬৪ টি। গত বছর নতুন দায়ের হয়েছে ১২ হাজার ৫২২ টি। নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৬ হাজার ৩৬০টি। এছাড়া দেশের ৬৪টি জেলার ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ২ লাখ ৩৯ হাজার ৪০১টি। এর মধ্যে গত বছর দায়ের হয়েছে ৩৮ হাজার ৬৯৬টি। নিষ্পত্তি হয়েছে ৫ হাজার ৩৩১টি। ২০১৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৬ হাজার ৩৬টি। আইন কমিশন মনে করে, মামলা জটের এ অবস্থা একদিনে বা এক বছরে হয়নি। বহু বছরের পুঞ্জীভূত সমস্যা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে এই অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।-ইত্তেফাক <প্রতি মুহুর্তের খবর পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিন
Discussion about this post