ছোট্ট দুটি শিশু। আপন দুই ভাই। একজনের বয়স পাঁচ বছর, আরেকজনের সাড়ে তিন। বাড়ির আঙিনায় ইচ্ছেমতো ছুটবে, খেলবে, হাসবে—এই তো হওয়ার কথা। কিন্তু কারাগারের প্রাচীরে আটকে গেছে তাদের উচ্ছলতা। ইচ্ছে হলেই তারা দৌড়াতে পারে না। খেলতে পারে না মনের মতো করে।
কেন তারা আদালতে? কী তাদের অপরাধ?
এই শিশু দুটির কারাবাসের কারণ তাদের মা। তিনি মাদক মামলার আসামি। ৯ মে তেজগাঁও থানার পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায়। পরে আদালতের নির্দেশে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। ওই শিশু দুটিও তাদের মায়ের সঙ্গে কারাগারে যায়। এরপর থেকে কারাগারই এখন তাদের ঠিকানা। মা কিন্তু সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বাও।
এই নারীর মতো প্রতিদিন ঢাকা মহানগরীতে তিন থেকে চারজন নারী গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান। এঁদের অধিকাংশই মাদক মামলা আসামি। গ্রেপ্তার এসব নারীর কোলে থাকে ছোট্ট শিশু। শেষ পর্যন্ত তাদের ঠাঁই হয় কারাগারে।
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত হাজতখানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক শেখ মো. রুহুল আমিন বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন মামলায় প্রায় প্রতিদিন তিন থেকে চারজন নারী গ্রেপ্তার হন। গত ছয় মাসে ৭৫ জন নারী শিশুসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন। এঁদের অধিকাংশ গরিব। তাঁদের কোলে থাকে শিশুসন্তান।
পাঁচ বছরের নিচের শিশুসন্তানসহ গ্রেপ্তার হওয়া নারীদের প্রথমে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের হাজতখানায় পাঠানো হয়। আদালতে পাঠানো প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকে, ‘নারী আসামির সঙ্গে শিশু বাচ্চা রয়েছে।’ পরে তাঁদের আদালতের আদেশ অনুযায়ী পাঠানো হয় কারাগারে। জামিন না মিললে ধার্য তারিখে তাঁদের আদালতে পাঠানো হয়। মায়েদের সঙ্গেও এসব শিশু নিয়মিতভাবে আদালত থেকে কারাগার, কারাগার থেকে আদালতে আসা-যাওয়া করে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত (সিএমএম) হাজতখানার একটি কক্ষে নারীদের রাখা হয়। শিশুরা মায়েদের সঙ্গে এখানে থাকে। মায়েরা গুঁড়ো দুধসহ প্রয়োজনীয় সব খাবার সঙ্গে নিয়ে আসেন। ছোট্ট একটি কক্ষে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। কারণ, প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জন নারীকে আদালতে আনা হয়।
আদালতের হাজতখানায় কর্মরত কয়েকজন নারী পুলিশ সদস্য বলেন, শিশুদের জন্য তাঁদের খুব খারাপ লাগে। এসব নিষ্পাপ শিশুর মুখের দিকে তাকালে মায়া হয়। শিশুরা প্রায় সময় কান্নাকাটি করে। মায়েদের কারণে এসব শিশু বেড়ে উঠছে কারাগারে।
ঢাকার মহানগর পুলিশের অপরাধ ও তথ্য বিভাগ সূত্র বলছে, ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গত বছর মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান ৬৪৪ জন নারী। থানা-পুলিশ গ্রেপ্তার করে ৫৭৩ জনকে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ গ্রেপ্তার হন ৭১ জন নারী।
কারাগার সূত্র নিশ্চিত করেছে, বর্তমানে কাশিমপুর ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৬০৪ জন নারী বন্দী রয়েছেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রায় প্রতিদিন শিশুসহ নারীরা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আসছেন। আগে থেকে অনেক শিশুও মায়েদের সঙ্গে কারাগারে আছে। যেসব নারী আসামির সঙ্গে শিশু আছে, তাঁদের আলাদা বিভাগে রাখা হয়। শিশুদের দুধসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করা হয়। কারাগারের ভেতরে রয়েছে ডে কেয়ার সেন্টার। শিশুদের পড়ানোর শিক্ষকও রয়েছেন। তারপরও কারাগার মানেই বন্দিজীবন।
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার বলেন, নিয়মিত শিশুরা মায়েদের সঙ্গে কারাগারে যাচ্ছে। অপরাধের সংস্পর্শে আসা মানুষের সঙ্গে তারা বেড়ে উঠছে। এসব শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁরা চিন্তিত।
Discussion about this post